সবজির বিভিন্ন ধরনের রোগ বালাই - টমেটোর পাতা কোকরানো ভাইরাস রোগ
সবজির বিভিন্ন ধরনের রোগ বালাই এবং টমেটোর পাতা কোকরানো ভাইরাস রোগ এ সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য জানতে চান তাহলে মনোযোগ সহকারে নিম্নের আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।
এই আর্টিকেলে আমরা আরো আলোচনা করছি ডগা এবং ফলের মাজরা পোকা/কান্ডের মাজরা পোকা এবং টমেটোর ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট রোগ। এছাড়া আরও আলোচনা করছি কিছু গুরুত্বপূর্ণ টপিক এর সম্বন্ধে সেগুলো জানতে হলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ার অনুরোধ রইলো।
সবজির বিভিন্ন ধরনের রোগ বালাই
ফলের মাছি পোকা
আক্রান্ত সবজীঃ সব ধরনের কুমড়া জাতীয় সবজি, টমেটো, ঢেঁড়স, সীম, শসা।
রোগ প্রতিকারঃ আক্রান্ত ডগাগুলি তুলে ফেলুন এবং মাটিতে পুঁতে ফেলুন। বিষ টোপ (১০০ গ্রাম মিষ্টি কুমড়া এবং ৮/৯ ফোটা নগস) দিয়ে পোকা-মাকড় মেরে ফেলুন।
জাব পোকা
আক্রান্ত সবজীঃ বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপি, শালগম, মূলা, বরবটি, টমেটো।
রোগ প্রতিকারঃ জাব পোকা হাতের সাহায্যে মারাই উৎকৃষ্ট পদ্ধতি। যদি এভাবে দমন না হয় তখন সুপারিশকৃত কীটনাশক সাবধানে ব্যবহার করতে হবে যাতে মৌমাছি এবং পরাগায়নে সহায়তাকারী পতংগের কোনরূপ তি না হয়। সাবান পানি দিয়েও দমন করা যায়।
আরো পড়ুনঃ আঙ্গুর গাছের কান্ড ছাঁটাই
বিটল
আক্রান্ত সবজীঃ কুমড়া জাতীয় সবজি, শসা।
রোগ প্রতিকারঃ বিটল হাতে তুলে মারা যায় এবং কেরোসিন ও কাঠের ছাই ছিটিয়েও দমন করা যায়। বেশী আক্রান্ত হলে সুমিথিয়ন, ফলিথিয়ন জাতীয় তরল স্প্রে করতে হবে এবং ফুরাডান, বাসুডিন বা ঐ জাতীয় দানাদার কীটনাশক মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে।
কাটুই পোকা
আক্রান্ত সবজীঃ বাঁধাকপি, ফুলকপি, পেঁপে, বেগুন, আলু, টমেটো।
রোগ প্রতিকারঃ আক্রান্ত গাছ (শাখা ও ডগার কাটা অংশ) খুঁজে তার নিকট মাটি থেকে কাটুই পোকা বের করে বিনষ্ট করতে হবে। ছোট গাছগুলির চারিদিকে ছাই- কেরোসিন মিশ্রণ প্রয়োগ করতে হবে। তবে চিটাগুড়, হেপ্টাক্লোর এবং ধানের তুষ মিশিয়ে সন্ধ্যায় জমিতে দিয়ে দমন করা যায়।
ডগা এবং ফলের মাজরা পোকা/কান্ডের মাজরা পোকা
আক্রান্ত সবজীঃ ঢেঁড়স, বেগুন, টমেটো, সীম।
রোগ প্রতিকারঃ আক্রান্ত ডগা ও ফল সংগ্রহ করে ধ্বংস করুন। পাতা ও ডগা থেকে সংগৃহীত পোকার ডিমগুলি ধ্বংস করুন। গাছে ছাই ব্যবহার করুন।
সাদা মরিচা
আক্রান্ত সবজীঃ লাল শাক ও ডাঁটা শাক।
রোগ প্রতিকারঃ আক্রান্ত অংশ ধ্বংস করে ফেলুন।
মোজাইক ভাইরাস
আক্রান্ত সবজীঃ ঢেঁড়স, টমেটো, পেঁপে, মিষ্টিকুমড়া, আলু, শসা, বাঁধাকপি।
রোগ প্রতিকারঃ আক্রান্ত গাছগুলি উপড়ে ফেলুন এবং জাবপোকা, পাতাফড়িং ও অন্যান্য বাহক পোকা যাতে রোগ ছড়াতে না পারে সেজন্য আক্রান্ত গাছ পুড়িয়ে ফেলুন।
আরো পড়ুনঃ আলুর রোগ ও পোকা প্রতিরোধ পরিচর্যা
পাতা মোড়ানো ভাইরাস
আক্রান্ত সবজীঃ ঢেঁড়স, মিষ্টিকুমড়া, টমেটো, বেগুন।
রোগ প্রতিকারঃ তাৎক্ষনিকভাবে আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলুন এবং আগাছা পরিষ্কার করুন। এই রোগ বহনকারী পোকামাকড় দমন করুন।
পাতায় দাগরোগ
আক্রান্ত সবজীঃ বাঁধাকপি, পুঁইশাক, পালংশাক, মূলা, সীম, টমেটো, লাউ, বেগুন, করলস্না।
রোগ প্রতিকারঃ আক্রান্ত গাছ আংশিক বা সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলুন। বোদ্দ মিক্সার প্রয়োগ করুন। আগাছা পরিষ্কার করে ও শস্য পর্যায় অবলম্বন করে ভালো ফল পাওয়া যায়।
পাতায় দাগরোগ
আক্রান্ত সবজীঃ বাঁধাকপি, পুঁইশাক, পালংশাক, মূলা, সীম, টমেটো, লাউ, বেগুন, করলা।
রোগ প্রতিকারঃ আক্রান্ত গাছ আংশিক বা সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলুন। বোদ্দ মিক্সার প্রয়োগ করুন। আগাছা পরিষ্কার করে ও শস্য পর্যায় অবলম্বন করে ভালো ফল পাওয়া যায়।
ঢলে পড়া রোগ
আক্রান্ত সবজীঃ বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, বেগুন।
রোগ প্রতিকারঃ রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করুন এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করুন। ডায়াথেন এম-৪৫ প্রয়োগ করুন।
ফিউজারিয়াম উইল্ট
আক্রান্ত সবজীঃ বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, বেগুন, সীম, শসা।
রোগ প্রতিকারঃ রোগ প্রতিরোধী জাতের বীজ ব্যবহার, শস্য বীজ অবলম্বন করুন, আক্রান্ত গাছ উপড়ে ফেলুন এবং বোদ্দ মিক্সার ব্যবহার করুন।
পাউডারী মিলডিউ
আক্রান্ত সবজীঃ টমেটো, বেগুন, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, সীম, শসা।
রোগ প্রতিকারঃ আগাছা দমন করুন, বোদ্দ মিক্সার বা ডায়াথেন এম-৪৫ আক্রান্ত গাছে স্প্রে করুন।
ডাউনি মিলডিউ
আক্রান্ত সবজীঃ পালংশাক, লাউ, সীম, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া, করলা।
রোগ প্রতিকারঃ আক্রান্ত গাছের অংশ বা সম্পূর্ণ গাছ পুড়িয়ে ফেলুন এবং বোদ্দ মিক্সার স্প্রে করুন।
টমেটোর পাতা কোকরানো ভাইরাস রোগ
আক্রান্ত লক্ষণঃ এক প্রকার সাদা মাছি এ রোগ ছাড়ায়। এ রোগ হলে গাছ ছোট হয়ে যায়। যাকে বলে Stunting growth তাছাড়া, পাতার দুধার থেকে গোল হয়ে যায়। পাতা হলদে হয়ে যায়। কোকরানো পাতাগুলো পরে ঘন হয়ে চামড়ার মত শক্ত ও উজ্জ্বল হয়ে যায়।
রোগ প্রতিকারঃ রোগ প্রতিরোধী জাত রোপন করতে হয়। চারা লাগানোর পর পরই সিসটেমিক কীটনাশক নিগান্ড বা কার্বোফুরান প্রতি লিটার পানিতে মিলিয়ে ৫ হতে ৬ বার স্প্রে করতে হবে। অথবা কার্বোফুরান ১.৫৬ ইসি/হেক্টর জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
টমেটোর মোজাইক ভাইরাস
আক্রান্ত লক্ষণঃ গাছের পাতার গায়ে সবুজ ও হালকা সবুজ ছোপ ছোপ দাগ এবং গাছ আকারে ছোট হয়ে যায়।
আরো পড়ুনঃ ঢেঁড়স গাছের পোকামাকড় আক্রমণ
রোগ প্রতিকারঃ নিরোগ বীজ ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত গাছের উপস্থিতি আছে সেরূপ জমিতে টমেটোর চাষ করা যাবে না।
টমেটোর নেতিয়ে পড়া বা ধ্বসা ধরা রোগ
আক্রান্ত লক্ষণঃ বীজ তলায় এ রোগ দেখা দেয়। কয়েক প্রকার ছত্রাকের আ?মনে এ রোগ হয়। প্রথমে চারা গাছের কান্ড আ?ান্ত হয়। পরে শিকড়ে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে ও চারা গাছটি মাটির সমতলে নেতিয়ে পড়ে ও পরে মারা যায়।
রোগ প্রতিকারঃ রোগ দমনের জন্য বীজ তলার মাটি হালকা ও ঝুর ঝুর করতে হবে। বীজ ছত্রাক নাশক এরাসান (প্রতি ১.৪ কেজি) দিয়ে ৫৬.৫ গ্রাম বীজ শোধন করতে হবে। চারা গজানোর পর বীজ তলায় বেশি পানি দেয়া যাবে না।
টমেটোর আগাম ধ্বসা রোগ
আক্রান্ত লক্ষণঃ বয়স্ক পাতায় প্রথম লক্ষণ দেখা যায়। পরে অন্য পাতায় এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এ দাগগুলো বৃত্তাকার ও বাদামী রঙের হয়।
রোগ প্রতিকারঃ রোগ দমনের জন্য আগাছা নষ্ট করতে হবে। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করতে হবে। গাছ বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে রুভরাল প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ছিটিয়ে দিতে হবে।
টমেটোর নাবী ধ্বসা রোগ
আক্রান্ত লক্ষণঃ প্রথমে বয়স্ক পাতায় সবুজ কালো পানি ভেজা দাগ দেখা যায়। দাগগুলো খুব তাড়াতাড়ি বাড়তে থাকে এবং অনুকুল আবহাওয়া অন্যান্য গাছে ছড়িয়ে পড়ে।
আরো পড়ুনঃ ঢেঁড়শের বীজ বপনের পদ্ধতি
রোগ প্রতিকারঃ আলু ও টমেটো পাশাপাশি জমিতে লাগানো যাবে না। ৫ হতে ১০ মিঃ পর পর শতকরা ১৬ ভাগ (১০ গ্রাম তুতে+১০ গ্রাম চুন+১ লিটার পানি রিডোমিল ২ গ্রাম প্রতি লিটার ছিটাতে হবে)।
টমেটোর ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট রোগ
আক্রান্ত লক্ষণঃ মাটিতে বসবাসকারী একপ্রকার ব্যাকটেরিয়া এই রোগ ছড়ায়। গাছের ক্ষতের মধ্য দিয়ে এই রোগের জীবানু ঢুকে পড়ে রোগ প্রতিকার: আক্রান্ত গাছের পাতা ঢলে পড়ে এবং গাছ মারা যায় রোগ হয়ে গেলে গাছকে বাঁচানো যাবে না।
রোগ প্রতিকারঃ ৪/৫ বৎসরের মধ্যে জমিতে তামাক, আলু, বেগুন, মরিচ, টমেটো লাগানো যাবে না। আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলতে হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরোক্ত অজৈব পদ্ধতিগুলি প্রয়োগের সুপারিশ শুধুমাত্র তখনই করা হয় যখন সর্ব প্রকারের জৈব পদ্ধতি অকার্যকর বলে প্রতীয়মান হয়।
সমন্বিত দমন বা প্রতিরোধ
১। গভীর করে পরিচ্ছন্নভাবে জমি চাষ করা।
২। পোকার আক্রমণমুক্ত সুস্থ-সবল ভাল জাতের বীজ ও চারা ব্যবহার।
৩। রোপণ সময় পরিবর্তন করে কিছু কিছু পোকার আক্রমণ কমানো যায়।
৪। নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করা।
৫। সবজি ক্ষেতে বাঁশ, খুঁটি বা গাছের ডাল পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করা।
৬। আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে ক্ষেতের বাইরে এনে ধ্বংস করা।
৭। মরা পাতা, আবর্জনা ইত্যাদি পরিষ্কার করা।
৮। অধিক ইউরিয়া সার ব্যবহার না করে জমিতে জৈব সার ব্যবহার করা।
৯। বিষটোপ বা বিষ ফাঁদ ব্যবহার করে পোকা ধরার ব্যবস্থা করা।
১০। ফাঁদ ফসল চাষ করা। যেমন বেগুন ক্ষেতে জ্যাসিডের জন্য ঢেঁড়স চাষ।
১১। জাব পোকা, ছাতরা পোকা, জ্যাসিড, মাকড় ইত্যাদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পোকার আক্রমণ খুব বেশি না হলে ক্ষেত পরিদর্শনের সময় হাত দ্বারা পিষে মেরে ফেলা।
১২। বিভিন্ন ধরনের উপকারী পোকা যেমন লেডি বার্ড বিটল, ক্যারাবিড বিটল, সিরফিড মাছি, পেন্টটাটমিড বাগ, পিঁপড়া এবং মাকড়সা সবজির বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকা শিকার করে খায়। বহু রকমের বোলতা রয়েছে যারা বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকার ডিম, কীড়া, পুত্তলি ইত্যাদিকে পরজীবীতার দ্বারা ধ্বংস করে। কাজেই অযথা এলোপাতাড়ি কীটনাশক না ছিটিয়ে আইলে ফুল জাতীয় সবজি লাগিয়ে এদের সংরক্ষণ ও বংশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা যাতে ক্ষতিকর পোকা দমন করা যায়।
আশা করি সবজির বিভিন্ন ধরনের রোগ বালাই এবং টমেটোর পাতা কোকরানো ভাইরাস রোগ এ সম্পর্কে জানাতে পেরে আমরা খুবই আনন্দিত এবং আপনাদের অনেক উপকার হবে। এরকম গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল পেতে অবশ্যই আমাদের ওয়েবসাইটটি নিয়ম মত ফলো করুন। আর্টিকেলটি যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে তাহলে শেয়ার করুন ধন্যবাদ।