সহপাঠঃ লালসালু উপন্যাসের অনুধাবনমূলক প্রশ্ন ও নমুনা উত্তর
বিগত বোর্ড পরীক্ষাসমূহের CQ প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতামূলক প্রশ্নের নমুনা উত্তর
সহপাঠঃ লালসালু উপন্যাসের অনুধাবনমূলক প্রশ্ন ও নমুনা উত্তর
০১। সুপ্রভা প্রভুত্ব করার চেয়ে নির্ভর করিতেই ভালোবাসে বেশি, আদর পাওয়াটাই তার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্য। মন্দার গৃহিণীপনার ভিত্তিও ওইখানেই-সুপ্রভাকে সে নয়নের মণি করিয়া রাখিয়াছে। কে বলিবে সুপ্রভা তাহার সতীন? স্নেহ-যত্নে সুপ্রভার দিনগুলিকে সে ভরাট করিয়া রাখে। সতীনের সংসারেও তাই এখানে কলহ-বিবাদ, মান-অভিমান মন-কষাকষি নাই।
(গ) উদ্দীপকের সাথে 'লালসালু' উপন্যাসে বর্ণিত ঘটনার সাদৃশ্য রয়েছে।" বুঝিয়ে লেখ।
উত্তরঃ (গ) উদ্দীপকের সাথে 'লালসালু' উপন্যাসে বর্ণিত যে ঘটনার সাদৃশ্য রয়েছে সেটি হল মজিদের দুই স্ত্রী রহিমা এবং জমিলার মিলেমিশে থাকা। 'লালসালু' উপন্যাসে মজিদের প্রথম পক্ষের স্ত্রী রহিমা। নিঃসন্তান বলে মজিদ যখন দ্বিতীয় বিয়ে করতে আগ্রহ প্রকাশ করে তখন রহিমা আপত্তি জানায়নি। সন্তান লাভের আশায় মজিদ তার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে ঘরে তুলে আনে জমিলাকে।
জমিলার চরিত্রে কৈশোরক চপলতাই প্রধান। দাম্পত্য গাম্ভীর্য তার মধ্যে প্রবেশ করে না। এমনকি রহিমাকেও তার সতীন বলে ঈর্ষার বিষয় বলে মনে হয় না। রহিমা তার কাছে মাতৃসম বড় বোন হিসেবেই বিবেচিত হয় এবং তার কাছ থেকে তদ্রূপ স্নেহ আদর পেয়ে অভিমান-কাতর থাকে। জামিলাকে পেয়ে রহিমার মনেও শাশুড়ির ভাব জাগে। আদর যত্ন করে খাওয়ায় দাওয়ায় তাকে।
অপরদিকে উদ্দীপকের সুপ্রভা ও মন্দাও সতীন। তবুও সুপ্রভা প্রভুত্ব করার চেয়ে নির্ভর করতে ভালবাসে। আদর পাওয়াই তার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্য। মন্দার গৃহিণীপনার ভিত্তিও সেখানেই। সে সুপ্রভাকে নয়নের মণি করে রেখেছে। স্নেহে-যত্নে তাদের দিন বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছে। তাই সতীনের সংসারেও কোনো কলহ-বিবাদ, মান-অভিমান নেই। এ সকল সাদৃশ্যের কারণে বলা যায়, উদ্দীপকের সাথে 'লালসালু' উপন্যাসের রহিমা ও জমিলার ঘটনার মিল রয়েছে।
(ঘ) উদ্দীপকের 'মন্দার' ও 'সুপ্রভার' চেয়ে পাঠ্য উপন্যাসের রহিমা ও জমিলা অধিকতর প্রাণবন্ত ও শক্তিশালী।”-বিশ্লেষণ কর।
উত্তরঃ (ঘ) 'উদ্দীপকের 'মন্দার' ও 'সুপ্রভার' চেয়ে পাঠ্য উপন্যাসের রহিমা ও জমিলা অধিকতর প্রাণবন্ত এবং শক্তিশালী"- মন্তব্যটি যথার্থ। 'লালসালু' উপন্যাসের রহিমা ও জমিলা মজিদের দুই স্ত্রী। রহিমা-মজিদ নিঃসন্তান ছিল বলে জমিলা এ বাড়ির ছোটো বউ হয়ে আসে। নতুন বউ জমিলাকে পেয়ে রহিমার মনে শাশুড়ির ভাব জাগে। তাকে আদর যত্ন করে খাওয়ায়।
অনেক সময় মজিদের কড়া শাসন থেকেও রক্ষা করে। জমিলাও রহিমাকে তার মাতৃসম বড়বোন হিসেবে দেখে। তার কাছ থেকে স্নেহ ভালবাসা দাবি করে। একে অপরের সুখে দুঃখে পাশে থাকে। মজিদ যখন জমিলাকে মাজার-ভীতি প্রদর্শন করতে নানাভাবে বাধ্য করতে থাকে তখনও রহিমা জমিলার পাশে থেকে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়।
অপরদিকে উদ্দীপকের সুপ্রভা ও মন্দার সতীনের সংসারে কোনো প্রকার কলহ বিবাদ নেই। সুপ্রভা নির্ভর হয়ে থাকতে পছন্দ করে, আদর পাওয়াকেই জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্য হিসেবে মনে করে। আর মন্দার সুপ্রভাকে নয়নের মণি করে রাখে।
কিন্তু স্নেহে যত্নে সুপ্রভার দিনগুলো ভরে রাখলেও রহিমা, জমিলার মত প্রাণবন্ত ও শক্তিশালী তারা নন। উপন্যাসে জমিলাকে দেখা যায় মজিদের একক অধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী-চরিত্র হিসেবে। রুদ্ধতার নায়ক মজিদের বিপরীতে জমিলা ছিল একটি প্রাণময় সত্তা। আবার, জমিলাকে মাজারে বন্দি করে রাখা হলে শান্তশিষ্ট, স্বামীভক্ত রহিমাও মজিদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
এভাবে তাদের চরিত্রের প্রাণময়তা উপন্যাসে প্রকাশ পায় যা উদ্দীপকে অনুপস্থিত। তাই বলা যায়, উদ্দীপকের 'মন্দা' ও 'সুপ্রভার' চেয়ে পাঠ্য উপন্যাসের রহিমা ও জমিলা অধিকতর প্রাণবন্ত ও শক্তিশালী।
০২। আব্দুল জব্বার মৃধা নিঃসন্ধান বলে তার মনে অনেক কষ্ট। সামাজিক ও পারিবারিকভাবে অনেক হেয় হতে হয় তাকে। একদিন সে তার স্ত্রী মেরিনাকে তার এমন অবস্থার কথা খুলে বললে নিজেই উদ্যোগী হয়ে স্বামীর বিয়ে দেয় সেরিনা, গরিব ঘরের অল্প বয়সি মেয়ে সুচরিতার সাথে বিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে আসে। কিন্তু সুচরিতা বাবার বয়সি জব্বার মৃধাকে স্বামী বলে মেনেই নিতে চায়না। তাই তার মুখে থুথু দেয় ও ভেংচি কাটে। জব্বার মৃধা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সুচরিতাকে অনেক কষ্টদায়ক শাস্তি দেয়। সন্তানতুল্য মেয়েটিকে কষ্ট পেতে দেখে মেরিনাও ভীষণ কষ্ট পায়। মনের অজান্তেই চোখ মোছে শাড়ির আঁচলে।
(গ) সুচরিতা চরিত্রটি 'লালসালু' উপন্যাসের কোন চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? আলোচনা কর।
উত্তরঃ (গ) সুচরিতা চরিত্রটি 'লালসালু' উপন্যাসের জমিলা চরিত্রটির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
উদ্দীপকের আব্দুল জব্বার মৃধা নিঃসন্তান বলে প্রথম স্ত্রী মেরিনা নিজেই উদ্যোগী হয়ে স্বামীর বিয়ে দেয়। গরিব ঘরের অল্প বয়সি মেয়ে সুচরিতার সাথে বিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে আসে। কিন্তু সুচরিতা কোনোভাবেই বাবার বয়সি জব্বার মৃধাকে স্বামী বলে মেনে নিতে চায়না। তার মুখে থুথু দেয়, ভেংচি কাটে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জব্বার মৃধা তাকে অনেক কষ্টদায়ক শাস্তি দেয়।
'লালসালু' উপন্যাসে জমিলা মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে মজিদের ঘরে আসে। প্রথম স্ত্রী রহিমার এতে কোনো আপত্তি ছিল না। কারণ মজিদ-রহিমা নিঃসন্তান ছিল। কিশোরী জমিলা বিয়ের পরেও তার চাঞ্চলতা ছাড়েনি। সে রহিমার মত ধর্মভীরুও নয়। ধর্মপালন ও স্বামীর প্রতি দায়িত্ব পালন উভয় ক্ষেত্রেই তার উদাসীনতা ছিল।
তাকে শাসনের ব্যাপারে মজিদের সকল উদ্যোগ তার কাছে অত্যাচার মনে হত। এমনকি সে এই পীড়ন থেকে মুক্তি লাভের জন্য মজিদের মুখে থুথু নিক্ষেপ করে। জমিলা এখানে একজন প্রতিবাদী নারী চরিত্র। যার মিল আমরা উদ্দীপকের সুচরিতার ক্ষেত্রেও দেখতে পাই। অতএব, সুচরিতা চরিত্রটি 'লালসালু' উপন্যাসের জমিলা চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
(ঘ) উদ্দীপকের জব্বার মৃধা 'লালসালু' উপন্যাসের মজিদ চরিত্রের আংশিক ধারণ করেছে।"-মন্তব্যটি বিশ্লেষণ কর।
উত্তরঃ (ঘ) উদ্দীপকের জব্বার মৃধা 'লালসালু' উপন্যাসের মজিদ চরিত্রের আংশিক ধারণ করেছে।"- উক্তিটি যথার্থ।
উদ্দীপকের আব্দুল জব্বার মৃধা নিঃসন্তান ছিলো বলে প্রথম স্ত্রী মেরিনার উদ্যোগে দ্বিতীয় বিয়ে করে। সুচরিতা তার দ্বিতীয় স্ত্রী। অল্প বয়সি সুচরিতা কোনোভাবেই বাবার বয়সি আব্দুল জব্বারকে স্বামী বলে মেনে নিতে পারে না। তার মুখে থুথু দেয় ও ভেংচি কাটে। জব্বার মৃধা ক্ষুব্ধ হয়ে সুচরিতাকে অনেক কষ্টদায়ক শাস্তি দেয়।
এখানে জব্বার মৃধার অত্যাচারী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। 'লালসালু' উপন্যাসের 'মজিদ' চরিত্রটি জব্বার মৃধা চরিত্র থেকে অনেকাংশেই ভিন্ন। মজিদ চরিত্রটি কুসংস্কার, শঠতা, প্রতারণা ও অন্ধবিশ্বাসের প্রতীক। সে সাধারণ মানুষের ধর্মভীরুতার সুযোগ নিয়ে মহব্বতনগর গ্রামে মাজার ব্যবসা শুরু করে। তার প্রথম স্ত্রী রহিমা নিঃসন্তান।
তাই সে দ্বিতীয় বিবাহ করতে উদ্যত হয়। কিন্তু শুধুমাত্র সন্তান লাভের আশায় সে দ্বিতীয় বিয়ে করে নাকি তরুণী স্ত্রী লাভের আশায় সে বিষয়টিতে প্রশ্ন থেকে যায়। দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলা ধর্মভীরু নয় বলে নানাভাবে তার উপর নির্যাতন করে মজিদ। মাজার ভীতি বা মাজারের অধিকর্তা মজিদ ভীতি কোনোটিই জমিলার ছিল না।
স্বার্থপর মজিদ শেষ পর্যন্ত জীবনবিরোধী শোষক ও প্রতারকের ভূমিকাই পালন করে। উদ্দীপকের জব্বারের মাঝে অত্যাচারী দিকটি ফুটে উঠলেও মজিদের মতো ধর্মব্যবসা, প্রতারণা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য তার মাঝে দেখা যায় না। এ কারণে বলা যায় যে, উদ্দীপকের জব্বার মৃধা 'লালসালু' উপন্যাসের মজিদ চরিত্রের আংশিক ধারণ করেছে।
০৩। গ্রামের স্কুল শিক্ষক বাবা তমিজুদ্দীন তাঁর ছেলে রাসেলকে শহরের বড় প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠায়। রাসেল ডাক্তার হয়ে বাবার মুখ উজ্জ্বল করে ফিরে আসে গ্রামে। তার ইচ্ছা গ্রামের অসহায়, দুস্থ রোগীদের আধুনিক চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলবে এবং তাবিজ কবজ, ঝাড় ফুঁক ও পানিপড়া প্রভৃতি অন্ধ বিশ্বাস থেকে গ্রামবাসীদের মুক্ত করবে। কিন্তু ব্যাপারটা গ্রামের মোড়ল করিম খান মেনে নিতে পারে না। রাসেল যাতে গ্রামের মানুষদের সচেতন করতে না পারে সেই চেষ্টা করতে থাকে সে, কিন্তু রাসেল কোনো দিকে কর্ণপাত না করে এগিয়ে যায় নিজের লক্ষ্যের দিকে।
(গ) উদ্দীপকের রাসেল চরিত্রটির সাথে 'লালসালু' উপন্যাসের তুলনীয় চরিত্র কোনটি? আলোচনা কর।
উত্তরঃ (গ) উদ্দীপকের রাসেল চরিত্রটির সাথে 'লালসালু' উপন্যাসের তুলনীয় চরিত্র হল আভাস।
উদ্দীপকের রাসেলের বাবা তমিজুদ্দীন তার ছেলেকে শহরের বড় প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠায়। রাসেল ডাক্তার হয়ে বাবার মুখ উজ্জ্বল করে ফিরে আসে গ্রামে। তার ইচ্ছা গ্রামের অসহায়, দুস্থ রোগীদের আধুনিক চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলবে এবং চিকিৎসার ব্যাপারে নানা অন্ধ বিশ্বাস থেকে গ্রামবাসীদের মুক্ত করবে।
কিন্তু এই ব্যাপারটি গ্রামের মোড়ল করিম খান মেনে নিতে পারেননি। রাসেলকে তিনি নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করতে থাকেন। কিন্তু রাসেল এতে কর্ণপাত না করে এগিয়ে যায় নিজের লক্ষ্যের দিকে। অপর দিকে 'লালসালু' উপন্যাসের মোদাব্বের মিঞার ছেলে আক্কাস বিদেশ ছিল বহুদিন। তার আগে করিমগঞ্জের স্কুলে নিজে কিছুদিন লেখাপড়া করেছে।
এরপর চাকরি করে পয়সা জমিয়ে গ্রামে ফিরেছে। ছেলে দেশে ফেরায় মোদাব্বের মিঞা খুব খুশি। ছোটবেলা থেকে আক্কাস উচক্কা ধরনের ছেলে ছিল। গ্রামে ফিরেও সে মুরব্বিদের বুদ্ধি সম্পর্কে তার ঘোরতর সন্দেহ প্রকাশ করে। সে চায় এলাকায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে। সে জানে স্কুলে না পড়লে মুসলমানদের পরিত্রাণ নেই।
তাই সে কারো কথার তোয়াক্কা না করে স্কুলের জন্য চাঁদা তুলতে লাগল, সরকারের কাছে আবেদন করে দিলো। কিন্তু মজিদের শঠতায় তা আর সম্ভব হয়নি। তাই বলা যায়, সর্বসাধারণের কল্যাণ কামনার দিক থেকে উদ্দীপকের রাসেল চরিত্রের সাথে লালসালু উপন্যাসের আক্কাস চরিত্রটি তুলনীয়।
(ঘ) উদ্দীপক ও 'লালসালু' উপন্যাস উভয়ই অন্ধ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনজীবনের আলেখ্য।"- মন্তব্যটি বিশ্লেষণ কর।
উত্তরঃ (ঘ) 'উদ্দীপক ও 'লালসালু' উপন্যাস উভয়ই অন্ধ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনজীবনের আলেখ্য- মন্তব্যটি যথার্থ।'
উদ্দীপকের রাসেল ডাক্তার হয়ে গ্রামে ফিরে আসে। তার ইচ্ছা গ্রামের অসহায়, দুস্থ রোগীদের আধুনিক চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলবে। তার গ্রামের লোকজন এখনো তাবিজ কবজ, ঝাড়-ফুঁক ও পানিপড়া প্রভৃতি অন্ধবিশ্বাসে নিমজ্জিত। সে চায় তাদেরকে এই অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার থেকে মুক্ত করবে। গ্রামের মোড়ল করিম খান এটা মেনে নিতে পারেনা। সে চায়না গ্রামের মানুষরা সচেতন হোক। এতে সে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
অপরদিকে 'লালসালু' উপন্যাসের মহব্বতনগর গ্রামের মানুষরাও যুগ-যুগ ধরে শেকড় গাড়া কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসে বিশ্বাসী। কুসংস্কারের সাথে সুস্থ জীবনাকাঙ্ক্ষার দ্বন্দু এই গ্রামের জনজীবনে। মজিদ গ্রামবাসীর এই সরলতার ও ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে প্রতারণার জাল বিস্তার করে। মজিদ তাদেরকে ধর্মের নামে যা বলে তারা তাকেই সত্য মেনে জীবন পরিচালনা করে।
মাজারের কোনো সত্যতা না থাকা সত্ত্বেও রোগ মুক্তি লাভের আশায়, সন্তান লাভের আশায় নানা মানতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে ছুটে আসে। মাজারে টাকা পয়সা দিতে থাকে। এছাড়া মাজার কেন্দ্রিক বা ধর্ম কেন্দ্রিক নানা কুসংস্কার মেনে নিজেদের জীবন পরিচালনা করেন। আক্কাসের স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তারা মেনে নিতে পারেনা নিজেদের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার এবং মজিদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধার কারণেই।
অতএব, উদ্দীপক ও 'লালসালু' উপন্যাসের উভয়ই অন্ধ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনজীবনের আলেখ্য।
০৪। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'মাসি-পিসি' গল্পে অসহায়, নিঃস্ব দুই বিধবা নারীর অস্তিত্ব রক্ষার পাশাপাশি বিরূপ পরিবেশ থেকে আহ্লাদিকে রক্ষার জন্য। যে প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে তা গল্পটিকে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। অত্যাচারী স্বামী, লালসা-উন্মত্ত জোতদার, দারোগা ও। বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে। আহ্লাদিকে নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে দুই বিধবা নারীর দায়িত্বশীল ও মানবিক জীবন-যুদ্ধ সত্যিই প্রশংসনীয়।
(গ) উদ্দীপকের নারীদের সাথে 'লালসালু' উপন্যাসের নারী চরিত্রের সাদৃশ্য আলোচনা কর।
উত্তরঃ (গ) উদ্দীপকের নারী চরিত্র দুটির মধ্যে আমরা সমাজে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক স্বার্থবাদী চরিত্রের বিপরীতে গিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় লাড়াই করতে দেখি। 'লালসালু' উপন্যাসে অনুরূপ নারী চরিত্রটি হলো জমিলা। 'লালসালু' একটি সামাজিক সমস্যামূলক উপন্যাস যেখানে আমরা ধর্মব্যবসায়ী ও শোষক ভূ-স্বামী শ্রেণির আধিপত্য এবং সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতার চিত্র দেখতে পাই।
উপন্যাসটির বেশিরভাগ নারী চরিত্রকেও আমরা দেখি সমাজের এ প্রচলিত প্রথাকে বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিতে। কিন্তু মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলা এই প্রথার বিপরীত একটি চরিত্র। উপন্যাসে লেখক তাকে দেখিয়েছেন নির্জীব ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে সজীব প্রথাধর্মের জাগরণী চরিত্ররূপে। জমিলার মধ্য দিয়েই উপন্যাসটিতে নারীধর্ম, হৃদয় ধর্ম ও সজীবতার প্রকাশ ঘটেছে। মজিদের অন্যায় অত্যাচার সে মেনে নেয়নি। সে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। মহব্বতনগরের রুদ্ধ জীবনের মাঝে সে মুক্তির সুবাতাস হয়ে দেখা দিয়েছে।
উদ্দীপকের নারীদের মাঝেও আমরা মুক্তির এ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করি। তারা বিধবা হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের ও আহ্লাদিকে সমাজের বিরূপ পরিবেশ থেকে রক্ষা করতে বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। অত্যাচারী স্বামী, লালসা উন্মত্ত জোতদার, দারোগা তথা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কলুষতা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে তারা সংগ্রামী হয়ে উঠেছে।
সাহসিকতার সাথে তারা নানা বিরূপ ও প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। তাদের এরূপ কার্যক্রমের মধ্যে প্রথাবদ্ধ জীবন থেকে বেরিয়ে এসে একটি মুক্ত ও স্বাধীন জীবন যাপনের চিত্র পরিলক্ষিত হয় যা লালসালু উপন্যাসের জমিলা চরিত্রের মধ্যেও উপস্থিত।
(ঘ) উদ্দীপকের 'অস্তিত্ব রক্ষা' শব্দটি 'লালসালু' উপন্যাসের 'মজিদ' চরিত্রে কীভাবে দেখানো হয়েছে? বিশ্লেষণ কর।
উত্তরঃ (ঘ) 'লালসালু' উপন্যাসে মজিদকে কুসংস্কার, শঠতা, প্রতারণা এবং অন্ধবিশ্বাসের প্রতীক চরিত্ররূপে দেখানো হলেও তার এ সকল বৈশিষ্ট্যের মূলে রয়েছে মূলত তার নিজের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম।
উদ্দীপকের মাসি-পিসি তাদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রখর বুদ্ধিমত্তার আশ্রয় নেয়। সাহসিকতার সাথে তারা নানা প্রতিকুলতা মোকাবেলা করে টিকে থাকে। অত্যাচারী স্বামী, লালসা উন্মত্ত জোতদার, দারোগা ও বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করে তারা নিজেদের ও আহ্লাদিকে নিরাপদ রাখার জন্য সংগ্রাম করে যায়।
তাদের অস্তিত্ব রক্ষার এ সংগ্রাম 'লালসালু' উপন্যাসের মজিদের মধ্যেও দেখা যায়। মজিদের আগমন এক শস্যশূন্য জনবহুল এলাকা থেকে যেখানে প্রতিনিয়ত মানুষকে টিকে থাকার জন্য লড়াই করতে হয়। এরকম এক লোকালয় থেকে উঠে এসে মজিদ নিজের বুদ্ধি ও আত্মবিশ্বাসের বলে মহলতনগরে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
কিন্তু নিজের প্রতাপ ও প্রতিষ্ঠা সুদৃঢ় করলেও এর ওপর যে আঘাত আসতে পারে সে বিষয়ে মজিদ সর্বদা সজাগ থাকে। সে জানে, স্বাভাবিক মানবধর্ম তার ধর্মীয় অনুশাসন এবং শোষণের অদৃশ্য বেড়াজাল ছিন্ন ভিন্ন করে দিতে পারে। ফলে ফসল ওঠার সময় যখন গ্রামবাসী আনন্দে গান গেয়ে ওঠে, সেই গান বন্ধ করতে সে তৎপর হয়ে ওঠে। রহিমার স্বচ্ছন্দ চলাফেরায় সে বাধা দেয়।
আক্কাস আলিকে সর্বসমক্ষে অপমানিত ও লাঞ্চিত করে। ঈশ্বরে বিশ্বাসী হলেও সে প্রতারণা ও ভণ্ডামির মাধ্যমে তার মাজারকে টিকিয়ে রাখতে চায়। আবার, মাঝে মাঝে সে তার সমস্ত কূট-কৌশল গ্রামবাসীর কাছে ফাঁস করে দিয়ে গ্রাম ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবার কথাও ভাবে। এ সকল কারণে তার চরিত্রে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম।