রজনীগন্ধা পোকামাকড় ও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ - রজনীগন্ধা কন্দ বা চারা লাগানোর পদ্ধতি

রজনীগন্ধা পোকামাকড় ও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ এবং রজনীগন্ধা কন্দ বা চারা লাগানোর পদ্ধতি সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য জানতে চান তাহলে আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।
রজনীগন্ধা চাষের জন্য জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ
দ্রুত ফলনশীল গাঁদা ফুলের চাষএই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করছি রজনীগন্ধা ফুলের বংশবিস্তার পদ্ধতি এবং রজনীগন্ধা চাষের জন্য জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ। এছাড়া আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টপিক বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে সেইগুলো জানতে হলে আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো।

রজনীগন্ধা ফুলের চাষ করার পদ্ধতি


রজনীগন্ধা একটি জনপ্রিয় ফুল। রজনীগন্ধা (Polianthes tuberosa) একটি সুগন্ধি ফুল যা বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত মূল্যবান। এ ফুলের চাষ বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে প্রচলিত। সারা বছরই বাজারে এই ফুলের চাহিদা বেশি থাকে এবং সারা বছরই এই ফুল চাষ করা যায়। তবে শীতকালে কিছুটা কম ফোটে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এই ফুলের বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে।

ব্যবহারঃ সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এবং কাট ফুল হিসেবে ফুলদানী সাজাবার কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এছাড়া এই ফুলের নির্যাস হতে সুগন্ধিও তৈরি করা হয়। বাজারে ডাটাসহ কুচা ফুলের কদরও রয়েছে।

রজনীগন্ধা ফুলের উৎপাদন মৌসুম


রজনীগন্ধা ফুলের উৎপাদন মৌসুম এবং এর চাষের জন্য সঠিক সময় জেনে নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে ফুলের ভালো ফলন এবং মান নিশ্চিত করা যায়। রজনীগন্ধা একটি বারমাসি ফুল হলেও এর প্রধান উৎপাদন মৌসুম মার্চ থেকে এপ্রিল। রজনীগন্ধার বংশ বিস্তারের জন্য ভালো মানের, রোগমুক্ত ও সুস্থ কন্দ সংগ্রহ করতে হবে। সাধারণত মার্চ থেকে এপ্রিল এবং সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাসে রজনীগন্ধার কন্দ রোপণ করা উপযুক্ত সময়। কন্দগুলো ৬-৮ ইঞ্চি গভীরতায় রোপণ করতে হয় এবং কন্দগুলোর মধ্যে ১০-১২ ইঞ্চি দূরত্ব বজায় রাখতে হয়।

রজনীগন্ধার জাত


রজনীগন্ধা ফুলের বৈচিত্র্য অনুযায়ী তিন ধরনের রজনীগন্ধা ফুল দেখতে পাওয়া যায়। সিঙ্গল, সেমি ডাবল, ডাবল। একসারি পাপড়িযুক্ত সিঙ্গল জাতের গন্ধ বেশি। এই জাতের ফুলের চাহিদাও বাজারে প্রচুর। সেমি ডাবল ফুলে ২-৩ সারি পাপড়ি হয়ে থাকে এবং এগুলো মাঝারি গন্ধযুক্ত। ডাবল ফুল ৩ সারি পাপড়িযুক্ত হয়ে থাকে। এই জাতের ফুলের গন্ধ তুলনামূলকভাবে কম। ফলে বাজারে এই ফুলের চাহিদা গন্ধের দিক থেকে কিছুটা কম।

রজনীগন্ধা ফুলের বংশবিস্তার পদ্ধতি


রজনীগন্ধার কন্দ লাগিয়ে বংশবৃদ্ধি করা হয়ে থাকে। এই কন্দ রজনীগন্ধার শিকড়ের সাথে হয়।
ফুল ফোটার পর গাছের পাতাগুলো শুকিয়ে গেলে এবং গাছের উপরের অংশ শুকিয়ে গেলে কন্দ সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত, রোপণের ৬-৮ মাস পর কন্দ সংগ্রহ করা যায়। কন্দগুলো ভালোভাবে সংগ্রহ করে শুকিয়ে নিতে হবে। 

কন্দগুলোকে শীতল, শুষ্ক ও বায়ু চলাচলযোগ্য স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। রোপণের আগে কন্দগুলোকে ২-৩ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখা যেতে পারে। উক্ত কন্দ প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম নীল কপার ও ১ মিলি ম্যালাথিয়ন মিশ্রিত পানিতে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। পানি ঝরিয়ে ২-৩ দিন ছায়ায় শুকিয়ে জমিতে লাগাতে হবে। এতে কন্দের চারা দ্রুত গজায়। দোআঁশ বা বেলে-দোআঁশ মাটি রজনীগন্ধার জন্য উপযুক্ত। মাটিতে জৈব সার (যেমন পচা গোবর বা কম্পোস্ট) মিশিয়ে ভালোভাবে চাষ করতে হবে।

রজনীগন্ধা চাষের জন্য জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ


রজনীগন্ধা চাষের জন্য উঁচু ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত দোআঁশ মাটি উপযুক্ত। জমি ভালোভাবে চাষ করে মাটির ঢেলাগুলো ভেঙ্গে মিহি করতে হবে। মাটিতে জৈব সার, যেমন পচা গোবর বা কম্পোস্ট মিশিয়ে নিতে হবে। প্রথম চাষের সঙ্গে প্রতি বিঘা জমিতে ৩ টন জৈবসার বা খামারের সার মিশাতে হবে। এবং চার/পাঁচ বার গভীরভাবে চাষদিয়ে আগাছামুক্ত করতে হবে ও জমির মাটি ঝুরঝুরে ও সমান করতে হবে। 

শেষ চাষের আগে প্রতি বিঘাতে ১৪:২৮:২৮ ইউরিয়া, টিএসপি, এমপি সার মূল সার হিসেবে জমিতে মিশাতে হবে। এঁটেল মাটিতে ১০% সার কম দিলেও চলে। ২ মাস পর হতেপ্রতি ২ মাস অন্তর অন্তর ৭ কেজি ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির কাজ চারা লাগাবার অন্তত ১৫ দিন আগে শেষ করতে হবে। টবে চাষের ক্ষেত্রে ২ ভাগ মাটি, ১ ভাগ পাতা পচা সার, ১ ভাগ পচা গোবর সার মিশিয়ে টব ভরে নিতে হবে। একটি টবে ২টি কন্দ লাগানো যায়।

রজনীগন্ধা কন্দ বা চারা লাগানোর পদ্ধতি


রজনীগন্ধার কন্দ লাগিয়ে বংশবৃদ্ধি করা হয়। ২.৫-৩ সেমি ব্যাসের কন্দ জমিতে লাগানোর উপযুক্ত। প্রতি ৩ বছর অন্তর জমিরকন্দ পরিবর্তন করা উচিত। বীজের জন্য নির্বাচিত ঝাড় তুলে পরিষ্কার করে ছায়াচ্ছন্ন জায়গায় পাতলা করে বিভিয়ে রাখতে হবে। লাগাবার কয়েকদিন আগে আরেকবার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে পানিতে ধুয়ে নির্বাচিত কন্দ পৃথক করে নিতে হবে এবং ৩-৪ দিন ছায়াতে ছড়িয়ে রাখতে হবে।

রজনীগন্ধা ফুলের কন্দ বা চারা রোপন দূরত্ব


কন্দগুলো ৬-৮ ইঞ্চি গভীরে রোপণ করতে হবে এবং কন্দগুলোর মধ্যে ১০-১২ ইঞ্চি দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। রোপণের পর পর্যাপ্ত পানি দিতে হবে। ৩০ সেমি X ৩০ সেমি বা ৪০ সেমি X ৩০ সেমি দূরত্বে লাগাতে হবে। প্রতি ৫-৬ সারি অন্তর ১ সারি ফাঁকা রাখলে যাতায়াত, পরিচর্যা ও বর্ষাকালে নিকাশী নালা হিসাবেকরা যাবে। টবের ক্ষেত্রে ১টি টবে ২টি কন্দ লাগানো যায়।

রজনীগন্ধা চারার পরিচর্যা ও সেচ


রোপণের পর নিয়মিত সেচ দিতে হবে, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে এবং ফুল ফোটার সময়। কন্দ লাগানোর ২০-২৫ দিন পর হতে নিয়মিত নিড়ানি দিয়ে জমি আগাছামুক্ত করতে হবে। প্রয়োজন হলে হালকা সেচ দিতে হবে। প্রত্যেক বার সার প্রয়োগের পর হালকা সেচ দিতে হবে। গরমকালে প্রয়োজনমত ১০-১৫ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে। 

১৫ দিন পরপর মিশ্র সার (যেমন ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি) প্রয়োগ করতে হবে। আগাছা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে যাতে গাছের বৃদ্ধিতে কোনো বাধা সৃষ্টি না হয়। নিয়মিত গাছ পরীক্ষা করে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। টবের ক্ষেত্রে কন্দ অংকুরিত হওয়া পর্যন্ত টবে মাটি ভিজে রাখতে হবে। এরপর ভিজে থাকলে অংকুর পঁচে নষ্ট হতে পারে। তাছাড়া ফুল আসার সময় মাটি ভেজা থাকলে ফুল আসতে দেরি হয়। শীতকালে ১০ দিন পর ও গ্রীষ্মকালে ৭ দিন অন্তর অন্তর সেচ দিতে হয়।

রজনীগন্ধা পোকামাকড় ও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ


নিয়মিত  রজনীগন্ধা গাছ পরীক্ষা করে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। শুঁয়াযুক্ত ও শুঁয়াহীন ল্যাদাপোকা কচিপাতা ও কুঁড়ি খেয়ে ফসলের ব্যাপক ক্ষীত করে থাকে। এর সাথেগোড়া পচা, শিষ ঢলে পড়া, পাতায় হলুদ দাগ, পাতা শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি রোগের প্রকোপে রজনীগন্ধা বাগানের ক্ষতি হতে পারে। পোকা দমনেরজন্য ০.২% ম্যালাথিয়ন এবং রোগ দমনের জন্য ০.১% কার্বেন্ডাজিম বা ০.২৫% ম্যানকোজেবের জলীয় দ্রবণ স্প্রে করতে হবে।

রজনীগন্ধা ফুলের ফসল তোলা


রজনীগন্ধার উৎপাদন সাধারণত বছরব্যাপী হলেও প্রধানত দুটি সময়ে এর উৎপাদন বেশি লক্ষ্য করা যায়। মার্চ-এপ্রিল রোপণের ক্ষেত্রে, জুলাই-আগস্ট থেকে ফুল ফোটা শুরু হয় এবং অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর রোপণের ক্ষেত্রে, ডিসেম্বর-জানুয়ারি থেকে  রজনীগন্ধা ফুল ফোটা শুরু হয় এবং মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। 

ফসল লাগানোর পর হতে ৩ বছর পর্যন্ত রজনীগন্ধা ভাল ফুল দিয়ে থাকে। এরপর হতে ফলন কমতে থাকে ও ফুলের মান কমতে থাকে। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ভাল মানের, বেশি পরিমাণ ফলন পাওয়া যায়। শীতকালে ফলন কমে যায়। দ্বিতীয় বৎসর সবচেয়ে বেশি ফলন হয়ে থাকে। একটি ভাল মিষে ৩০ জোড়া ফুল থাকতে পারে। কুচা ফুলের জন্য ফুল ফোটার একদিন আগে বিকালবেলা কুঁড়ি তোলা উচিত। ফুল ফুটে গেলে বাজার মূল্য কমে যায়।

রজনীগন্ধা ফুলের ফলন


রজনীগন্ধা ফুলের উৎপাদন মৌসুম ও পরিমাণ আবহাওয়ার উপর অনেকটাই নির্ভর করে। মাঝারি তাপমাত্রা এবং পর্যাপ্ত সূর্যালোকযুক্ত এলাকায় এই ফুল ভালো হয়। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও জলাবদ্ধতা থেকে ফুলের গাছকে রক্ষা করা উচিত, কারণ এটি ফুলের গুণমান ও উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। 

রজনীগন্ধা ফুল সাধারণত সন্ধ্যার সময় ফোটে, তাই ভোরবেলা বা সন্ধ্যায় ফুল তোলা উত্তম। ফুল সংগ্রহের পর সতর্কতার সাথে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে ফুলের মান বজায় থাকে। প্রতি বিঘাতে ১ম বৎসর প্রায় ৮-১০ কুইন্টাল কুচা ফুল পাওয়া যেতে পারে। ২য় বৎসর উক্ত ফলন হতে পারে ১৪-১৬ কুইন্টাল এবং ৩য় বৎসর ৭-৮ কুইন্টাল।

রজনীগন্ধা ফুলের বাজারজাতকরণের মাধ্যমে ভালো লাভ অর্জন করা যায়। এছাড়া, ফুল থেকে তৈরী সুগন্ধি বা অন্যান্য পণ্যেও বাণিজ্যিকভাবে ভালো লাভ পাওয়া যায়। রজনীগন্ধা চাষ একটি লাভজনক কৃষি উদ্যোগ হতে পারে যদি সঠিক নিয়মে ও যত্ন সহকারে চাষ করা হয়। আশা করি, উপরোক্ত নির্দেশনাগুলো রজনীগন্ধা ফুলের চাষে সহায়ক হবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url