লেবুর রোগ প্রতিরোধ ও পোকা দমন - বিভিন্ন জাতের লেবুর

লেবুর রোগ প্রতিরোধ ও পোকা দমন এবং দৈয়ে পোকা দমন ব্যবস্থা এ সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য জানতে চান তাহলে অবশ্যই মনোযোগ সহকারে এই আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।
লেবুর রোগ প্রতিরোধ ও পোকা দমন
এই আর্টিকেলে আমরা আরো আলোচনা করছি জাব পোকা দমনের উপায় এবং লেবুর ছাল খেকো পোকা দমন ব্যবস্থা। এছাড়া আরও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ টপিক বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো জানতে হলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ার অনুরোধ রইল।

বিভিন্ন জাতের লেবুর


১. কমলালেবু (Orange): কৃর্গ (Coorg), খাসিয়া (Khasia) নাগপুর সনত্রা (Nagpur Santra), খাসী কিন্নো (Kinnow), মালটা ব্লাড রেড (Malta blood red), ভেলেনসিয়া (Valencia), ওয়াশিংটন নেভেল (Washington Navel), দার্জিলিং (Darjeeling), শ্রীহট্ট প্রভৃতি।
২. কাগজী ও পাতিলেবু (Lime, & Lemon): গলগল, বীজশূন্য লেবু, ইউরেকা, নেপালী রাউণ্ড, ভিনা ফ্লাননকা ইটালিয়ান লেমন প্রভৃতি।
৩. বাতাবী লেবু (Pummelo): কৃষ্ণনগর-১, কৃষ্ণনগর-৩, ডানকান ওমোর্শ প্রভৃতি।

লেবুর রোগ প্রতিরোধ ও পোকা দমন


লেবুর গাছে বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড় থেকে রক্ষা করার জন্য কিছু কার্যকর পদ্ধতি ও দমন ব্যবস্থা করতে হবে। লেবুর গাছের আশেপাশের এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। গাছের নিচে পড়ে থাকা পাতা ও ফল সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। গাছের গোড়ায় পানি জমতে দেওয়া যাবে না, এটি রোগের বিস্তার ঘটাতে পারে। রোগাক্রান্ত ডালপালা এবং পাতা কেটে ফেলে গাছকে স্বাস্থ্যকর রাখতে হবে।

ক্যাংকার (Citrus Canker: C.O Xanthomonas citri): নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।

লেবুর ক্যাংকার রোগের লক্ষণ


এ রোগের আক্রমণে গাছের পাতা, কচি ডালে ও ফলে বাদামী রঙের মরচে ধরার মত গোলাকার বা লম্বা আকারের দাগ দেখা যায়। আর্দ্র আবহাওয়ায় রোগটি দ্রুত বিস্তারলাভ করে।

লেবুর ক্যাংকার রোগের দমন ব্যবস্থা (Control measures)


প্রতি লিটার জলে এক মিলিলিটার মনোক্রোটোফস যেমন নুভাক্রন, মোনোসিল ইত্যাদি বা আধ মিলিলিটার ফসফামিডন যেমন ডেমিক্রন-১০০ ই.সি গুলে এক সপ্তাহ অন্তর প্রয়োগ করতে হবে।

জাব পোকা (Aphid)


ভারতবর্ষে চার ধরনের জাব পোকা (যথা: Toxoptera citricida T. aurantii, Aphis pomi, ভারতবর্ষে চার লেবু গাছে আক্রমণ করে। এর মধ্যে বাদামী ডাবুর পাকা (T. citricida) Myzus por পোকা (T. aurantii)-র উপদ্রব বেশী দেখা যাযফরে। আবুর প্রভূত ক্ষতি করে থাকে। কালো জাড়া পাতার নিম্নপৃষ্ঠ, কচি শাখা ও ফলে আক্রমণ করে। আক্রান্ত পাতা ও শাখা কুঁকড়ে যায়। এছাড়া জাব পোকা ভাইরাস রোগ ছড়ায়।

জাব পোকা দমনের উপায়


প্রতি লিটার জলে এক মিলিলিটার হিসাবে মনোক্রোটোফস যেমন নুভাক্রন, মোনোসিল প্রভৃতি, অস্থিতি মটন মিথাইল যেমন মেটাসিসটক্স-২৫ ই-সি বা আধ মিলিলিটার ফসফামিডন যেমন অক্সিকোটন ০০ ই-সি বা এক মিলিলিটার মিথাইল প্যারাথিয়ন যেমন মেটাসিড-৫০ ই-সি গুলে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করতে হবে।

দৈয়ে পোকা (Mealy bug - Pseudococcus filamentosus Cockerell, Planococcus citri Risso) 


পোকা গাছের পাতা ও ডালে লেগে থাকে এবং দেখতে ছোট সাদা, বাদামী বা কালো রঙের হয়। পাতা ও ফল হলুদ বা ব্রোঞ্জ রঙের হয়ে যায় এবং বিকৃত হয়। দৈয়ে পোকা পাতার রস চুষে খায় এবং মধু স্রাব করে, যা পরে কালো ছত্রাক আক্রমণ করে। ফলে আক্রান্ত গাছের ফল অকালে ঝরে যায়।

দৈয়ে পোকা দমন ব্যবস্থা (Control measures)


প্রতি লিটার জলে এক মিলিলিটার মনোক্রোটোফাস যেমন নুভাক্রন, মোনোসিল প্রভৃতি বা ডাইমেথয়েট যেমন রোগর-৩০ ই-সি গুলে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করতে হবে।

লেবুর ছাল খেকো পোকা (Citrus bark borer Inderbela tetraonis/I. quadrinotata)


অবহেলিত ও পুরানো গাছের এটি একটি ক্ষতিকারক পোকা। এই পোকা ছাল খায় ও ছালের সংবহন কলাকে নষ্ট করে দেয়। রাত্রি বেলা পোকা গাছের ছাল খায়। তাই এদের আক্রমণ সহজে নজরে পড়ে না। তবে ছালের গুঁড়া ও পোকার মল দেখে পোকার আক্রমণ বোঝা যায়। 

লেবুর ছাল খেকো পোকা দমন ব্যবস্থা (Control measures)


কেরোসিন, পেট্রল, কার্বন ডাই সালফাইড বা ক্লোরোফর্ম ও ক্রিয়োজোট (২:১) মিশিয়ে গর্তে প্রয়োগ করে কাদা দিয়ে গর্তের মুখ বন্ধ করে দিতে হবে। এছাড়া গাছের ছালে বি-এইচ-সি-৫০ শতাংশ ও প্যারিস গ্রীন (Paris green) প্রয়োগ করেও পোকা দমন করা যায়।

কমলা লেবুর কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা (Orange Stem borer - Stromatium barbatum)


ভারতবর্ষে লেবুর এটি একটি অন্যতম পোকা। এই পোকার কীড়া গাছের শাখায় ছিদ্র করে ভেতরে প্রবেশ করে ও ভেতরের অংশ কুরে কুরে যায়। ফলে আক্রান্ত শাখা বা গাছ ঢলে পড়ে ও গাছটি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। আক্রান্ত শাখায় ছোট ছোট ছিদ্র দেখা যায়।

কমলা লেবুর কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা দমন ব্যবস্থা (Control measures) 


  • (১) আক্রান্ত শাখা কেটে বা লোহার তার দিয়ে গর্ত থেকে পোকা বের করে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • (২) কীড়ার গর্তে পেট্রল বা কার্বন বাই সালফাইডের ধূপন বিষ প্রয়োগ করতে হবে।
  • (৩) প্রতি লিটার জলে দু'মিলিলিটার এন্ডোসালফান যেমন থায়োডান ৩.৫ ই-সি বা মিথাইল প্যারাথিয়ন যেমন মেটাসিড ৫০ ই-সি গুলে পাতায় ডিমের উপর প্রয়োগ করলে পোকার উপদ্রব হ্রাস পায়।

প্রজাপতি (Citrus or Lemon butterfly Papilio demdeus etc.)


ভারতবর্ষের সর্বত্রই এই পোকার উপদ্রব দেখা যায়। এই পোকা গাছের পাতা খায় ও গাছকে পত্রহীন করে দেয়। পাতার নিচে বা উপরে ছোট সাদা বা হলুদ ডিম দেখা যায়। চারা গাছ এই পোকার আক্রমণে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া এই পোকা ফলের বোঁটায় আক্রমণ করে। ফলে অকালে ফল ঝরে পড়ে। সবুজ বা বাদামি রঙের লার্ভা পাতায় থাকে এবং দ্রুত পাতা খায়।

প্রজাপতি দমন ব্যবস্থা (Control measures)


আক্রান্ত গাছে ম্যালাথায়ন ৫ শতাংশ গুড়া প্রয়োগ করতে হবে। গাছের নিচে পড়ে থাকা পাতা ও ফল পরিষ্কার রাখা। লার্ভা বা ডিম থাকতে পারে এমন জায়গাগুলি নিয়মিত পরিষ্কার করা। গাছ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা, যাতে প্রাথমিক অবস্থায় প্রজাপতির ডিম এবং লার্ভা চিহ্নিত করা যায় এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। প্রতি লিটার পানিতে ২-৩ মিলি ক্লোরপাইরিফস মিশিয়ে স্প্রে করা। প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলি নিম তেল মিশিয়ে স্প্রে করা। নিম তেল লার্ভা এবং ডিম উভয়ের উপর কার্যকর।

লেবুর সাদা মাছি (Citrus White fly Aleurocanthus Sp.)


পূর্ণাঙ্গ ও অপূর্ণাঙ্গ পোকা পাতার রস চুষে খায়। মারাত্মক আক্রমণে পাতা হলদে হয়ে যায় ও অকালে ঝরে পড়ে। ফলে ফলন কম হয়। এই পোকা একরকম মধুর মত রস নিঃসরণ করে যাতে ছত্রাক জন্মায়।
পাতার রং হলুদ বা বাদামী হয়ে যায়। পাতার নিচের দিকে ছোট সাদা পোকা বা ডিম দেখা যায়।

লেবুর সাদা মাছি দমন ব্যবস্থা (Control measures)


আক্রান্ত পাতা ও ডালপালা কেটে পুড়িয়ে ফেলা। ছোট গাছ হলে গাছকে ঝাঁকিয়ে সাদা মাছি ঝরিয়ে ফেলা এবং পরে পোকামাকড় ধ্বংস করা। আক্রান্ত গাছে ০.০২৫ শতাংশ প্যারাথিয়ন বা ০-০৩ শতাংশ ম্যালাথিয়ন স্প্রে করতে হবে। সাবান মিশ্রিত পানি স্প্রে করা যেতে পারে। এতে সাদা মাছির দেহের মোমের আস্তরণ নষ্ট হয় এবং তারা মারা যায়।

ফলের মাছি (Fruit flies Dacus dorsalis)


স্ত্রী পোকা আধপাকা ফলের গায়ে হুল ফুটিয়ে ডিম পাড়ে এবং ফলের শাঁসের মধ্যেই শুক (maggot) বৃদ্ধি পেতে থাকে। আক্রান্ত ফল অকালে খসে পড়ে। এছাড়া ফলের ক্ষতস্থানে ছত্রাক ও ব্যাকটিরিয়া জন্মায়। ফলে আক্রান্ত ফল পচে যায়।

ফলের মাছি দমন ব্যবস্থা (Control measures)


  • (১) গাছ থেকে খসে পড়া আক্রান্ত ফল সংগ্রহ করে নষ্ট করে দিতে হবে। এতে পোকার সংখ্যা হ্রাস পায়।
  • (২) প্রতি লিটার জলে দু-মিলিলিটার ম্যালাথিয়ন-৫০ ই-সি বা ফেনথিয়ন যেমন লেবাসিড-১০০ ই-সি গুলে ফল পাড়ার দু'মাস আগে থেকে গাছে স্প্রে করতে হবে।

মাকড় পোকা (Mites Eutetranychus banksi)


পাতার রং হলুদ, বাদামী বা ব্রোঞ্জ হয়ে যায়। পাতার নিচে মাকড়ের জাল দেখা যায়। পাতায় ক্ষুদ্র সাদা বা হলুদ দাগ দেখা যায়। এই পোকা গাছের পাতা খায়, পাতায় ধূসর দাগের সৃষ্টি করে, পাতাকে দুর্বল করে দেয় এবং আক্রান্ত পাতা গাছ থেকে খসে পড়ে।

মাকড় পোকা দমন ব্যবস্থা (Control measures)


যদি কোন লেবু গাছে মাকরপোকা আক্রমণ করে তখন সেই পোকা দমনে ব্যবস্থার জন্য প্রতি লিটার জলে দু'মিলিলিটার ম্যালাথিয়ন বা প্যারাথিয়ন গুলে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করতে হবে। সালফার ভিত্তিক স্প্রে মাকড় পোকার বিরুদ্ধে কার্যকর।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url