সালোকসংশ্লেষণ (Photosynthesis) কি এবং এর রাসায়নিক বিক্রিয়া

সালোকসংশ্লেষণ (Photosynthesis) কি এবং এর রাসায়নিক বিক্রিয়া

সালোকসংশ্লেষণে কার্বন ডাই-অক্সাইড এর ভূমিকা

বিজ্ঞানী চার্লস রেইড বার্নেস Photosynthesis শব্দটি প্রচলন করেন। এটি একটি উপচিতি প্রক্রিয়া। যে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় সজীব উদ্ভিদকোষস্থ ক্লোরোফিল, পানির সহায়তায় সূর্যের আলোকশক্তিকে ATP ও NADPH নামক রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে এবং ঐ রাসায়নিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে CO₂ বিজারণের মাধ্যমে শর্করা জাতীয় খাদ্য প্রস্তুত ও উপজাত হিসেবে O₂ নির্গত করে তাকে সালোকসংশ্লেষণ বলে।
সালোকসংশ্লেষণ (Photosynthesis) এর রাসায়নিক বিক্রিয়া
12H2O + 6CO2 ⟶ C6H12O6 + 6H2O + 6O2

আলোর পরিচয়, বর্ণালী, শোষণ বর্ণালী ও কার্যকর বর্ণালী


  • ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ যা কোনো বস্তুকে খালি চোখে দৃশ্যমান করে।
  • এর উৎস সূর্য।
  • সূর্যের মধ্যে অবিরত হাইড্রোজেন পরমাণু হিলিয়াম পরমাণুতে রূপান্তরিত হয়। এ সময় শক্তি বিকিরিত হয় যাকে ফোটন কণা বলে। ১ মোল ফোটনকে বলে আইনেস্টাইন। ১ অণু গ্লুকোজ তৈরিতে ৫০-৬০ ফোটন কণা ব্যবহৃত হয়।
  • প্রতিটি ফোটন কণা দ্বারা বাহিত শক্তিকে কোয়ান্টাম বলে।
  • তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি হলে ফোটন কণার শক্তি কম হয়। তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম হলে ফোটন কণার শক্তি বেশি হয়। যেমন- লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৬৫০-৭৬০ ন্যানোমিটার এবং নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪৩০-৪৭০ ন্যানোমিটার। লাল আলোর প্রতি ফোটনে শক্তি থাকে ৪০ কিলোক্যালরি অথচ নীল আলোয় প্রতি ফোটনে শক্তি থাকে ৭০ কিলোক্যালরি।
  • দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৩৯০-৭৬০ ন্যানোমিটার।
  • সালোকসংশ্লেষণের সময় বেগুনি-নীল ও কমলা-লাল আলো বেশি ব্যবহৃত হয়।
  • তবে একক আলোক হিসেবে লাল আলোতে সালোকসংশ্লেষণ বেশি হয়।
  • সূর্য হতে আলোক শক্তির ৪০% পৃথিবীতে আসে। যার ৮৩% ক্লোরোপ্লাস্ট কর্তৃক শোষিত হয় (শোষিত আলোক শক্তির ০.৫-৩.৫% ক্লোরোফিল ও অন্যান্য রঞ্জক শোষণ করে)। ১২% বায়ুমন্ডলে প্রতিফলিত হয়, ৫% ভূগর্ভে প্রতিসরিত হয়।
  • সালোকসংশ্লেষণ দিনের বেলাতে হয় তবে কৃত্রিম আলোর উপস্থিতিতেও সালোকসংশ্লেষণ হওয়া সম্ভব।
সালোকসংশ্লেষণ (Photosynthesis) কি


রঞ্জক পদার্থের বৈশিষ্ট্যসমূহ


ক্লোরোফিলঃ রাসায়নিকভাবে ক্লোরোফিল পরফাইরিন মস্তক ও ফাইটলের একটি দীর্ঘ চেইনের সমন্বয়ে গঠিত।
  • সবুজ উদ্ভিদে-ক্লোরোফিল a (C55H72O5N4Mg): হলদে-সবুজ, ক্লোরোফিল b (C55H70O6N4,Mg): নীলাভ-সবুজ।
  • শৈবালে- ক্লোরোফিল c (C35H30O5N4Mg), ক্লোরোফিল d (C54H70O6N4Mg), ক্লোরোফিল e। 
  • ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রেঃ ব্যাকটেরিওক্লোরোফিল a, b (রোডোসিউডোমোনাস, রোডোস্পাইরিলাম, ক্লোরোবিয়াম প্রভৃতি সবুজ সালফার ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে ব্যাকটেরিওক্লোরোফিল থাকে।) ক্লোরোবিয়াম ক্লোরোফিল-৬৫০, ক্লোরোবিয়াম ক্লোরোফিল-৬৬০
Note:
  • ক্লোরোফিল ও একমাত্র রঞ্জক বা পিগমেন্ট যার শোষিত আলোকশক্তি সালোকসংশ্লেষণে কাজে লাগে এবং অন্যান্য পিগমেন্টগুলো তাদের শোষিত আলোকশক্তি ক্লোরোফিল কে প্রদানপূর্বক সালোকসংশ্লেষণে সাহায্য করে।
  • এছাড়া P-680 এবং P-700 নামক দুটি প্রতিক্রিয় রঞ্জক ক্লোরোফিল । আছে যারা যথাক্রমে 680 ন্যানোমিটার এবং 700 ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি বেশি শোষণ করে।

ক্যারোটিনয়েড এর বৈশিষ্ট্যসমূহ


এরাও সাহায্যকারী বা অ্যান্টেনা পিগমেন্ট।
১। ক্যারোটিনঃ কমলা বা লাল-কমলা বর্ণ
  • ক্যারোটিন একটি অসম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন যার রাসায়নিক সংকেত  C40H56
  • a, b, g, d এই চার ধরণের ক্যারোটিন পাওয়া যায়।
  • ক্যারোটিন নীলচে বেগুনি আলো (440nm-478nm) সর্বাধিক শোষণ করে।
  • ক্যারোটিনের বর্ণ বৈচিত্র্য সবচেয়ে আকর্ষণীয়। টমাটোতে লাল, গাজরে লালচে কমলা, বিভিন্ন ফুলে হলুদ, অ্যাভোকাডোতে সবুজ বর্ণের ক্যারোটিন পাওয়া যায়।
২। জ্যান্থোফিলঃ হলুদ বর্ণ
  • অক্সিজেনযুক্ত ক্যারোটিনকেই জ্যান্থোফিল বলে। জ্যান্থোফিলের রাসায়নিক সংকেত C40H56O2
  • লিউটিন নামক জ্যান্থোফিল সবুজ উদ্ভিদে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় যা ৯-ক্যারোটিনের জারণের ফলে উৎপন্ন হয়। এছাড়া টমাটোতে লাইকোজ্যান্থিন ও ভুট্টায় জিয়াজ্যান্থিন পাওয়া যায়।
  • বিভিন্ন শ্রেণির শৈবালে অন্তত বিশ ধরণের জ্যান্থোফিল পাওয়া যায়।

ফাইকোবিলিনস এর বৈশিষ্ট্যসমূহ


নীলাভ সবুজ শৈবাল ও লোহিত শৈবালে পাওয়া যায়। এরাও সহায়ক বা অ্যান্টেনা পিগমেন্টের কাজ করে।
১। ফাইকোএরিথ্রিন (C34H46O8N4): লাল বর্ণ
২ । ফাইকোসায়ানিন ( C34H44O8N4): নীল
৩ । অ্যালোফাইকোসায়ানিন

সালোকসংশ্লেষণে পানি কিভাবে শোষিত হয়


১। স্থলজ উদ্ভিদ মূলরোম দ্বারা মাটির কৈশিক পানি শোষণ করে।
২। জলজ উদ্ভিদ পানিতে নিমজ্জিত অঙ্গ দিয়েই পানি শোষণ করে থাকে।
৩। পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ (অর্কিড) বায়বীয় মূল দ্বারা বায়ুমন্ডল থেকে জলীয় বাষ্প শোষণ করে।

সালোকসংশ্লেষণের সময় কি উৎপন্ন করে


১ । অক্সিজেন উৎপন্ন করে।
২। সালোকসংশ্লেষণে বিজারিত NADPH+II+ এর ইলেকট্রনের উৎস হলো পানি।
৩। NADPH+H' থেকে পানির হাইড্রোজেন অংশ উৎপন্ন শর্করার উপাদান হিসেবে আবদ্ধ হয়।

সালোকসংশ্লেষণে কার্বন ডাই-অক্সাইড এর ভূমিকা


বায়ুমন্ডলে CO₂ এর পরিমাণ ০.০৩%/ ০.৪%। পানিতে CO₂ এর পরিমাণ ০.৩%।
১। স্থলজ উদ্ভিদের কার্বন ডাই অক্সাইডের উৎস বায়ুমন্ডলের CO₂। পত্ররন্ধ্র ও কিউটিকলের মধ্যে দিয়ে CO2 গ্যাস পাতায় পৌঁছায়।
২। অনেকগুলো জলজ উদ্ভিদ যাদের উপরের অংশ পানিতে ভাসে, স্থলজ উদ্ভিদের মতো তারা পাতার পত্ররন্ধ্র দিয়ে এবং কিউটিকলের সাহায্যে CO₂ শোষণ করে।
৩। নিমজ্জিত জলজ উদ্ভিদ পানিতে দ্রবীভূত CO₂ সমস্ত দেহে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় শোষণ করে।
Note:
  • জলজ উদ্ভিদের CO₂ এর উৎস পানিতে দ্রবীভূত কার্বন ডাই অক্সাইড এবং পানিতে দ্রবীভূত কার্বনেট ও বাইকার্বনেট যৌগ।
  • শ্বসন (Respiration), দহন (Combustion), বিয়োজন (Decomposition), গাঁজন (Fermentation) ইত্যাদি প্রক্রিয়াগুলোর মাধ্যমে উৎপন্ন CO₂ গ্যাস বায়ুমন্ডলের CO₂ গ্যাসের উৎস।

উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণকারী অঙ্গসমূহ


  • ১। পাতার সবুজ অংশ। উচ্চ শ্রেণির উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণের প্রধান অঙ্গই হলো সবুজ পাতা।
  • ২। সবুজ কচি কান্ড।
  • ৩। সবুজ উদ্ভিদের সম্পূর্ণ থ্যালাস।
  • ৪। ফুলের বৃতি ও বৃত্ত।
  • ৫। ফলের সবুজ ত্বক।
  • ৬। কতিপয় ব্যাকটেরিয়াতে সুগঠিত প্লাস্টিড না থাকাতে সাইটোপ্লাজমে ভাসমান ল্যামিলিতে সালোকসংশ্লেষণ হয়।
Note:
  • সবুজ শৈবাল, মস বর্গীয়, ফার্ণ বর্গীয়, নগ্নবীজী এবং আবৃতবীজী উদ্ভিদে ক্লোরোপ্লাস্ট থাকে এবং বর্ণ কণিকাগুলো এখানেই অবস্থান করে। কিন্তু সায়ানোব্যাকটেরিয়াতে এবং অন্য কিছু শৈবালে (বাদামী শৈবাল, লোহিত শৈবাল, ডায়াটম ইত্যাদি) বর্ণকণিকাগুলো থাইলাকয়েড বা ক্রোম্যাটোফোরে অবস্থান করে। এদের ক্লোরোপ্লাস্ট থাকে না।
  • পাতার উর্ধ্বত্বক ও নিম্নত্বকের অন্তর্বর্তী স্থানে, ক্লোরোপ্লাস্টযুক্ত যে প্যারেনকাইমা কলা থাকে, তাকে মেসোফিল কলা বা টিস্যু বলে। বিষমপৃষ্ঠ পাতায় এই কলা প্যালিসেড প্যারেনকাইমা ও স্পঞ্জি প্যারেনকাইমা দিয়ে গঠিত। অপরপক্ষে সমাঙ্গপৃষ্ট পাতায় কেবল স্পঞ্জি প্যারেনকাইমা কোষ ঘনসন্নিবিষ্টভাবে বর্তমান। প্যালিসেড প্যারেনকাইমা কোষে ক্লোরোপ্লাস্টের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এখানে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া অধিক মাত্রায় সম্পন্ন হয়।

কোন কোন জীবে সালোকসংশ্লেষণ সংঘটিত হয়


১। সালোকসংশ্লেষণকার উদ্ভিদঃ সালোকসংশ্লেষণকারী রঞ্জকযুক্ত ব্যাকটেরিয়া, নীলাভ সবুজ শৈবাল, শৈবাল এবং সকল ক্লোরোফিলযুক্ত উদ্ভিদ।
২। সালোকসংশ্লেষণকারী উদ্ভিদ মূলঃ গুলঞ্চের আত্তীকরণ মূল, অর্কিডের বায়বীয় মূল।
৩। সালোকসংশ্লেষণকারী কাণ্ডঃ ফণীমনসার পর্ণকাণ্ড, কচি কাণ্ড, ক্লোরোফিলযুক্ত সকল উদ্ভিদ কাণ্ড, যেমন- পুঁই, লাউ, কুমড়ো ইত্যাদি।
৪। সালোকসংশ্লেণকারী প্রাণীঃ ইউগ্নিনা (Euglena), ক্রাইস্যামিবা (Chrysamoeba) প্রভৃতি ক্লোরোপ্লাস্ট যুক্ত প্রাণী।
৫। সালোকসংশ্লেষণে অক্ষম উদ্ভিদঃ সকল শ্রেণির ছত্রাক, ক্লোরোফিলবিহীন পূর্ণ পরজীবী বা পূর্ণ মৃতজীবী উদ্ভিদ।
Note:
  • শৈবাল, সায়ানোব্যাকটেরিয়া এবং উচ্চতর উদ্ভিদে Oxygenic photosynthesis হয়।
  • কিছু জীবের (ফটোসিনথেটিক ব্যাকটেরিয়া) Anoxygenic photosynthesis হয়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url