হিন্দু আইনের দত্তক দাতাকেও আইনসঙ্গতভাবে উপযুক্ত হতে হবে

ভূমিকা (Introduction)


Adoption বা দত্তক গ্রহণ হিন্দু আইনের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। শুধুমাত্র হিন্দু আইনের নয়, রোমান আইনেও একে একটি Institution বা প্রতিষ্ঠান হিসাবে অভিহিত করা হয়। হিন্দু আইনের বিধান মোতাবেক অন্যের পুত্রকে নিজ পুত্ররূপে গ্রহণ করাকেই Adoption বা দত্তক গ্রহণ বলা হয়। পার্থিব এবং ধর্মীয়- এই দুইটি কারণেই দত্তক গ্রহণ করা হয়। 
দত্তক দাতাকেও আইনসঙ্গতভাবে উপযুক্ত হতে হবে
হিন্দু আইনে Adopted -son-কে Natural born son হিসাবে গণ্য করা হয় পুত্রহীনদের স্বর্গে কোন স্থান নাই, এই ধর্মীয় কারণই দত্তক গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য। আর সেই কারণেই মনিবর বশিষ্ট বলেন যে, 'অনন্তঃ পুত্রিনাং লোকানা পুত্রস্য লোকভীতি শ্রয়াতে" অর্থাৎ
Endless are the heavenly region for those having sons, but there is no heavenly region for asonless man."

দত্তকের সংজ্ঞা (Definition of Adoption)


হিন্দু আইনের বিধান মোতাবেক অন্যের পুত্রকে নিজ পূত্ররূপে গ্রহণ করাকে দত্তক বলা হয়। সুতরাং এইরূপ ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট পুত্র যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, সেই পরিবার হইতে অন্য এক পরিবারে স্থানান্তরিত (transferred) হয় এবং এইরূপ স্থানান্তর করাকেই Adoption বা দত্তক বলিয়া অভিহিত করা হয়। Adoption বা দত্তকের সংজ্ঞা দিতে গিয়া হিন্দু আইনবিদ Gour বলেন যে, 
"It is a formal recognition of a person of as the son of another."

দত্তক গ্রহণের মাধ্যমে দত্তকী পুত্র স্বীয় পিতা-মাতার পরিবার হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া দত্তকী পিতার পরিবারের সদস্য হয় এবং কতিপয় ব্যতিক্রম ব্যতীত স্বাভাবিক ও আইনসঙ্গত পুত্রের মর্যাদা লাভ করে। তাই, 31 DLR. 312 পাতায় যথার্থই বলা হইয়াছে যে,

“An adopted son is the creature of law. So an adopted son stands on an equal footing with natural son in matter of both temporal and spiritual"

সুতরাং অন্যের সন্তান নিজের সন্তান বলিয়া গ্রহণ করাই হইল দত্তক। নিজের সন্তান না থাকিলে কিংবা থাকিলেও সে ধর্মক্রিয়া সম্পাদনে অপারগ হলে দত্তক গ্রহণ করা যায় বর্তমানে কেবলমাত্র হিন্দু আইন ছাড়া অন্য কোন আইনে দত্তক প্রথা চালু নাই।

দত্তক গ্রহণ প্রাচীন আর্য সমাজে চালু ছিল। প্রথমে দত্তক প্রথার সাথে কোন ধর্মীয় অনুশাসন সংযুক্ত ছিল না। মনের টানে মানুষ দত্তক নিত। কারো ঔরসজাত সন্তান এবণ ছিল একটি বিকল্প ব্যবস্থা। দত্তক গ্রহণের সময় গ্রহীতাকে মন্ত্রবাণী উসজাত সন্তান বদিতে হয় 'আমি আমার পিতৃপুরুষের বংশধারা রক্ষার উদ্দেশ্যেই দত্তক গ্রহণ করলাম।

বৈধ দত্তকের উপাদান (Essentials of Valid adoption) 
হিন্দু আইনের বিধান অনুযায়ী বৈধ দত্তকের নিম্নলিখিত উপাদানগুলি রয়েছে।

দত্তক গ্রহীতার আইনসঙ্গত উপযুক্ততাঃ 


দত্তক গ্রহণ তখনই বৈধ বলিয়া গণ্য হইবে, যখন দত্তক গ্রহীতা নিম্ন লিখিত যোগ্যতার অধিকারী হইবে। যথা-
  • ক) দত্তক গ্রহণকারীকে একজন সুস্থ মস্তিস্ক সম্পন্ন পুরুষ হইতে হবে।
  • খ) দত্তক গ্রহণের সময় দত্তক গ্রহীতার কোন পুত্র পৌত্র অথবা প্রপৌত্র (স্বাভাবিক বা দত্তকী) থাকবে না।
  • গ) দত্তক গ্রহীতার ভালমন্দ বুঝিবার বয়স হতে হবে। বাংলাদেশে একজনের বয়স ১৫ বৎসর হলে তার ভালমন্দ বুঝবার বয়স হয়েছে বলে অনুমান করা হবে। অপর পক্ষে, মিতাক্ষরা শাসিত অঞ্চলে ১৬ বৎসর ধরা হয়।
  • ঘ) অবিবাহিত অথবা বিপত্নীক পুরুষও দত্তক গ্রহণ করতে পারেন।
  • ঙ) বাংলাদেশে কোন অবস্থাতেই একজন স্ত্রীলোক তার নিজের জন্য দত্তক নিতে পারেন না।
  • চ) সাধারণতঃ কোন বিধবা স্বামীর পূর্ব অনুমতি ছাড়া দত্তক গ্রহণ করতে পারেন না। তবে কোন কোন অবস্থাতে সে তার মৃত স্বামীর জন্য স্বামীর পক্ষে দত্তক গ্রহণ করতে পারেন।
তাই, PLD. 1947 P.C 165 গাতায় বলা হয়েছে যে, (A wife also can adopt to her husband, but no other female can adopt to any other male." একইভাবে, Narayana VS. Nanu (1870) নামক মামলার রায়ে বলা হয় যে, 
"A wife cannot adopt, while her husband is alive except with his express consent."

দত্তক দাতাকেও আইনসঙ্গতভাবে উপযুক্ত হতে হবে (The person giving in adoption must be legally competent to do so) 


দত্তক দাতার আইনসঙ্গত যোগ্যতা না থাকলে দত্তক প্রদান বৈধ বলে গণ্য হবে না। এই শর্ত অনুযায়ী দত্তক দাতার নিম্নলিখিত যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে, যথা-
  • ক) দত্তকদাতাকে অবশ্যই পিতা অথবা মাতা হতে হবে। কারণ একমাত্র পিতা-মাতাই দত্তক দানের উপযুক্ত ব্যক্তি বলে গণ্য।
  • খ) পিতার জীবিতকালে মাতা তার পুত্রকে পিতার সম্মতি ব্যতীত কারো নিকট দত্তক দিতে পারেন না।
  • গ) তবে পিতা যদি বিকৃত মস্তিস্ক হন অথবা সন্যাসব্রত অবস্থায় সংসার ত্যাগী হন, ত্ববে পিতার সুস্থ থাকা অবস্থায় প্রকাশ্যে অথবা ইঙ্গিতে কোন নিষেধ না থাকলে মাতা দত্তক দিতে পারেন।
  • ঘ) দত্তক দেওয়ার অধিকার পিতা-মাতার একান্ত ব্যক্তিগত অধিকার। তাই এই অধিকার কারো উপর অর্পণ করা যায় না। অর্থাৎ কোন প্রতিনিধির মাধ্যমে এই কাজ করানো যায় না।
  • ঙ) কোন অনাথকে দত্তক নেওয়া যায় না, কারণ অনাথের কোন বৈধ পিতা মাতা থাকে না।
  • এই প্রসঙ্গে 37 Mad 529 পাতায় যথার্থই বলা হইয়াছে যে, "The only persons who can lawfully give a boy in adoption are his father and mother.

দত্তকী ব্যক্তিকে অবশ্যই আইনগতভাবে দত্তকের উপযোগী বলে গণ্য হতে হবে (The adoptee should be lawfully capable of being taken in adoption) 


এই শর্তানুযায়ী দত্তক হিসাবে যাকে গ্রহণ করা হবে, তাকে অবশ্যই নিম্নলিখিত যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে, যথা-
  • ক) দত্তকী ব্যক্তিকে অবশ্যই পুরুষ হতে হবে।
  • খ) দত্তক দাতা ও-দত্তক গ্রহীতাকে একই বর্ণের হতে হবে।
  • গ) দত্তকী পুত্র এমন মায়ের সন্তান হবে না, যাকে দত্তক গ্রহীতা আইনগত ভাবে বিবাহ করতে পারত না।
  • ঘ) দত্তকী পুত্রের বয়স সম্পর্কে নানা প্রকার মতভেদ থাকিলেও ব্রাহ্মণদের বেলায় দত্তকীর বয়স কমপক্ষে ৯ বৎসর হতে হয়। কারণ ৯ বৎসরের সময় ব্রাহ্মণদের উপনয়ন হয়।
  • ঙ) বালুসু বনাম বালুসু মামলার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একমাত্র পুত্রকেও Factum Valet নীতি অনুযায়ী দত্তক দেওয়া এবং নেওয়া যায়।

আইনসঙ্গতভাবে দত্তক দেওয়া এবং নেওয়ার মাধ্যমে দত্তক গ্রহণ শেষ করতে হবে (The adoption is completed by an actual giving and taking) 


দত্তক দেওয়া নেওয়ার সময় তেমন কোন অনুষ্ঠানাদি পালন করা প্রয়োজন না হলেও একটি কাজ অবশ্যই করতে হয়- নলে সংশ্লিষ্ট দত্তক গ্রহণ বৈধ বলে গণ্য হয় না। অর্থাৎ এইক্ষেত্রে দত্তকী পুত্রকে শারীরিকভাবে এক পরিবার হতে অন্য পরিবারে আদান প্রদান করতে হয়। দত্তক দেওয়ার সময় পিতা অথবা পিতার অভাবে মাতা তার পুত্রকে দওকী পিতার নিকট অর্পণ করে এইরূপ বলে থাকে, 

"আমি আমার পুত্রকে আপনার নিকট দত্তক দিলাম, আপনি তাকে নিজ পুত্ররূপে গ্রহণ করুন। অনুরূপভাবে দত্তক গ্রহীতার দত্তকী পুত্রকে গ্রহণ করে উচ্চারণ করে, 'আমি অদ্য হতে তাকে নিজ পুত্ররূপে গ্রহণ করলাম। হিন্দু আইনে একে দত্তক আদান প্রদান বলে। এই প্রসঙ্গে 47 O.W.N-এ যথার্থই বলা হয়েছে যে, 

"The adoption is completed by an atonal giving and taking. The physical cal of giving and receiving is absolutely necessary for the validity of an adoption."

দত্তকের জাতিগত ও বর্ণগত সম্পর্ক 


দত্তক গ্রহণকারী, দত্তক দাতা এবং দত্তকের মধ্যে জাতিগত এবং বর্ণগত সম্পর্কের ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা থাকলে দত্তকগ্রহণ বৈধ হয় না।

দত্তক অনুষ্ঠানে কত আদান-প্রদানঃ 


দত্তক সন্তানকে দত্তক দাতা কর্তৃক সত্যিকারভাবে দত্তক গৃহীতার কাছে স্বশরীরে প্রদান করতে হবে এবং দত্তক গ্রহীতা সে জান গ্রহণ করিবেন। স্বশরীরে আদান-প্রদান না হলে দত্তক গ্রহণ বৈধ হবে না।

দত্তহোম (Datta Homa)  


দত্তক দেওয়া নেওয়া উপলক্ষে কোন যজ্ঞানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হলে দত্তহোম বলা হয়। দত্তক গ্রহণকালে দত্তহোম অনুষ্ঠান করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নাই, তবে সাধারণঃ ধনীক শ্রেণী দত্তক গ্রহণ করে বলে দত্তহোম অনুষ্ঠানের প্রচলন চলে আসছে।

উল্লেখিত আলোচনার প্রেক্ষাপটে উপসংহারে আমরা বলতে পারি যে, দত্তক গ্রহণ হিন্দু আইনের একটি সুপ্রাচীন বিধান। পার্থিব ও ধর্মীয় কারণে দত্তক সম্পর্কীয় বিধানাবলী হিন্দু আইনে গৃহীত ও স্বীকৃত হয়েছে। বৈধ দত্তকের অপরিহার্য উপাদান বা শর্তাবলী যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে দত্তকী পুত্র স্বাভাবিক পুত্রের মর্যাদায় বিভূষিত হয়। তাই, 31 BD.LR. 312 পাতায় যথার্থই বলা হয়েছে যে, 
An adopted son stands on an equal footing with a natural son."

একজন মহিলা বা বিধবা কখন দত্তক নিতে পারেন? When a woman or widow can adopt


একজন হিন্দু বিধবার দত্তক গ্রহণ সম্পর্কে মহাঋষি বশিষ্ট বলেন যে,
A woman should neither give nor receive a son except with the permission of her husband” 
অর্থাৎ স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোন হিন্দু মহিলা দত্তক প্রদান বা দত্তক গ্রহণ করতে পারে না।বশিষ্টের এই মতামত সম্পর্কে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের (Sub school) মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন-
  • (১) দায়ভাগ মতেঃ এই মতানুসারে বিধবা কর্তৃক দত্তক গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বামীর মতামত অপরিহার্য। তাই স্বামী জীবিতকালে অনুমতি দিয়া গেলে বিধবা স্বামীর পক্ষে তাহার (স্বামী) জীবিতকালে অনুমতি দিয়া গেলে বিধবা স্বামীর পক্ষে তাহার (স্বামী) মৃত্যুর পর আইনসঙ্গতভাবে দত্তক গ্রহণ করিতে পারে।
  • (২) মিথিলা মতেঃ এই মতপন্থীগণ দায়ভাগ মতাপন্থীদের নিয়মাবলী অনুসরন করেন।
  • (৩) মিথিলা মতেঃ এই মতে, স্ত্রী কর্তৃক দত্তক গ্রহণের সময় স্বামীর মতামত অবশ্যই প্রয়োজন। তাই, সেখানে কোন বিধবা দত্তক নিতে পারেন না।
  • (৪) বোম্বে, মাদ্রাজ ও পাঞ্জাব মতপন্থীঃ এই সকল মতপন্থী অনুযায়ী কতকগুলি শর্ত সাপেক্ষে বিধবা স্বামীর পক্ষে দত্তক গ্রহণ করতে পারেন। স্বামী কর্তৃক দত্তক নেওয়ার ক্ষমতা বা অধিকার মৌখিক বা লিখিতভাবে অথবা উইল দ্বারা দেওয়া যাতে পারে। তবে, এইরূপ ক্ষমতা স্বামী কর্তৃক লিখিত দলিল দ্বারা সম্পাদিত হলে উহা অবশ্যই রেজিষ্ট্রিকৃত হবে।
সর্বোপরি, Collector of Madura VS Mootoo মামলায় বলা হয় যে, 
'A woman has got no right to adopt and she acts merely as an agent of her husband, A man cannot authorise any other person except his wife to adopt."

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url