প্রবন্ধ নিবন্ধ রচনা শুদ্ধাচার

প্রবন্ধ নিবন্ধ রচনা শুদ্ধাচার
'জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল' অনুসারে শুদ্ধাচারের ধারণা
প্রবন্ধ-সংকেত ভূমিকা 'জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল' অনুসারে শুদ্ধাচারে ধারণা → শুদ্ধাচারের ক্ষেত্র → শুদ্ধাচার চর্চা উদাহরণ→ শুদ্ধাচার ও সৌন্দর্যের সঙ্গে আধুনির রাষ্ট্র → উদ্ধাচার ও নৈতিক শিক্ষা গুরুত→ ছাত্রজীবনে শুদ্ধাচারের গুরুত্ব → শুদ্ধাচারের প্রয়োজনীয়তা → উপসংহার। শুদ্ধাচারের শিক্ষা মানবাত্মার সম্পর্ক শুদ্ধাচারের শুদ্ধাচার ও পারিবারিক জীবনে শুদ্ধাচারের শুদ্ধাচারী হওয়ার উপায়→

ভূমিকাঃ


জীবনের সর্বস্তরে তথা সামাজিক, পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় জীবনে, খেলার মাঠ, কল-কারখানায়, দোকানে, রেলে, হাসপাতালে প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে নিয়মানুবর্তীতার বা শুদ্ধাচারেরর চর্চা করা হয়, তাই শুদ্ধাচার। শুদ্ধাচার মানুষের জীবনকে সুনিয়ন্ত্রিত করে। ব্যক্তিগতভাবে সবাই যখন শুদ্ধাচারী হয়ে উঠতে শুরু করে, তখন সমাজও ধীরে ধীরে শুদ্ধাচারী হয়ে ওটে। সমাজ থেকে অন্যায়- অত্যাচার দূর করে শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে শুদ্ধাচার ভূমিকা রাখে।

'জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল' অনুসারে শুদ্ধাচারের ধারণাঃ 


শুদ্ধাচার বলতে সাধারণভাবে নৈতিকতা ও সতৃতা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ বোঝায়। এটি দ্বারা একটি সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্য বোঝানো হয়। ব্যক্তি পর্যায়ে এর অর্থ হলো কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা তথা চরিত্রনিষ্ঠা।শুদ্ধাচারের ক্ষেত্র। মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই শুদ্ধাচারের গুরুত্ব ও উপস্থিতি রয়েছে। পরিবার, ঘরোয়া পরিবেশ, দৈনন্দিন জীবন, সামাজিক পরিমণ্ডল, শিক্ষা গ্রহণ ও কর্মক্ষেত্র সব জায়গাতেই শুদ্ধাচারের চর্চা করা যায়।

শুদ্ধাচার চর্চাঃ 


শুদ্ধাচারের চর্চার মধ্য দিয়ে মানবমন পরিপূর্ণতা ও প্রীতি লাভ করে। পৃথিবীর সকল পাপ-পুণ্য, ভালো-মন্দ, ধর্ম-অধর্মের পার্থক্য নির্ধারণে মানুষকে পরিচালিত করে তার মন। আর মনকে বিকশিত; উদ্ভাসিত ও প্রীতিময় করে তোলে শুদ্ধাচার ও সৌন্দর্যচর্চা। মন বা হৃদয় দ্বারা পরিচালিত হয়ে মানুষ সদ্ব্যবহার ও কাজ করে এবং শিক্ষা, সাধনা ও অনুশীলন তখনই সার্থক হয়, যখন মানুষ শুদ্ধাচারের অনুশীলন করে। মানবসত্তা শুদ্ধাচারের চর্চার মাধ্যমে বিকশিত হয়।

শুদ্ধাচারের শিক্ষাঃ 


শুদ্ধাচারের শিক্ষা মানুষের সামাজিকীকরণের অংশ। সামাজিকীকরণের প্রাথমিক দায়িত্ব পালন করে পরিবার, এ প্রক্রিয়ায় মানুষ সমাজের নিয়মকানুন সম্পর্কে জানে ও নৈতিকতা এবং মানবিকতা থেকে উৎসারিত আচরণ আত্মস্থ করে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও মানুষ শুদ্ধাচার শিখে থাকে। গুরুজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় খাওয়ার সময়, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার সময়, ধর্মীয় কাজে ও জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই শুদ্ধাচার চর্চা করা যায়। শুদ্ধাচারের শিক্ষা শৈশবে শুরু হয়ে আজীবন চলতে থাকে।

শুদ্ধাচারের উদাহরণঃ 


পারিবারিক জীবনে শুদ্ধাচারের উদাহরণ হলো- বাইরে থকে বাসায় ফিরে সবার খোঁজ নেওয়া, পরিবারের অন্যদের সুযোগ- সুবিধার কথা বিবেচনা করা, নিজের কাজ নিজে করার চেষ্টা করা ইত্যাদি। দৈনন্দিন জীবনে কারো সঙ্গে দেখা হলে তাকে আগে সালাম দেওয়া, স্মিত হেসে কথা বলা, অনুমতি ছাড়া কারো জিনিস না নেওয়া, জীবনে সময়ানুবর্তী হওয়া, যে স্থানের যে নিয়ম তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, নিজেকে নিয়মের ব্যতিক্রম না ভাবা শুদ্ধাচারের উদাহরণ। 

শিক্ষাক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঝগড়া না করা, শিক্ষক-শিক্ষিকাকে সম্মান করা, নিয়মিত ক্লাসে যাওযা, সময়মতো পড়া শেষ করা ইত্যাদি শুদ্ধাচারের অংশ। কর্মজীবনে মানুষকে প্রতিদিন অনেক ধরনের কাজ ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হয়। করণীয় ও বর্জনীয় আচরণ হলো কর্মক্ষেত্রের শুদ্ধাচার। কর্মক্ষেত্রে শুদ্ধাচারের মধ্যে নিজের কাজকে ভালোবাসা, কোনো কাজকে ছোটো মনে না করা, নিজের ভুল শিকার করা, নির্ধারিত সময়ে কর্মক্ষেত্রে আসা ইত্যাদি কর্মক্ষেত্রের শুদ্ধাচার।

শুদ্ধাচার ও সৌন্দর্যের সঙ্গে মানবাত্মার সম্পর্কঃ 

প্রবন্ধ নিবন্ধ রচনা শুদ্ধাচার
মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা অর্থাৎ সভ্য। কারণ, মানুষই কেবল শুদ্ধাচারের চর্চা করে থাকে। মানুষের বিবেক ও বুদ্ধির কারণে সে সৃষ্টির সেরা জীব। বিবেক মানুষকে ও মূল্যবোধ উদ্ভাসিত করে তোলে। মানুষ কেবল বাইরের দিকে কেমন তা নয়, তবে ভেতরে যা আছে তা তার প্রকৃত সৌন্দর্য নির্ধারণ করে। আর এই প্রবৃত্তিই হচ্ছে মানুষের অন্তর্নিহিত প্রবণতা। মানুষের ধা কিছু ভালো গুণ আছে তার চর্চাই হলো শুদ্ধাচার। যা প্রকাশ করে সৌন্দর্য।

শুদ্ধাচার ও আধুনির রাষ্ট্রঃ 


রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নিম্ন পর্যায় থেকে উচ্চপর্যায় সর্বক্ষেত্রে শুদ্ধাচারের চর্চা প্রয়োজন। একজন যোগ্য শাসকের গুণাবলি প্রকাশিত হয় তার শুদ্ধাচারের মধ্য দিয়ে। আধুনিক রাষ্ট্রকে কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করা হয়। কল্যাণ রাষ্ট্র তখনই সার্থকতা অর্জন করবে, যখন রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বস্তরে শুদ্ধাচার ও সৌন্দর্যের অনুশীলন থাকে। 

জাতীয় জীবনে সর্বোচ্চ পর্যায়ে শুদ্ধাচার প্রকাশ পায় রাষ্ট্র পরিচালনা ও নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে। শুদ্ধাচার চর্চার মধ্য দিয়ে অনেক রাষ্ট্র ও জাতি পেয়েছে বিনম্র, শান্ত, নিরপেক্ষ জাতির গৌরব। তাই ব্যক্তিনদীবনে যেমন শুদ্ধাচার চর্চা রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি হ্রাস করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।

শুদ্ধাচার ও নৈতিক শিক্ষাঃ 


সকল প্রকার অমঙ্গলকর, অনৈতিকতা, অশ্লীলতাকে পরিহার করে বিশুদ্ধ জীবনাচারের শিক্ষা গ্রহণ করাই হচ্ছে নৈতিক শিক্ষা। পারিবারিক আবহে, বসবাসের পরিমণ্ডলে আত্মীয় স্বজনদের প্রভাবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, গুরুজন, খেলার সঙ্গী, সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব সকলের সাহচর্যে ধীরে ধীরে শৈশব-কৈশোর জুড়েই মানুষ নৈতিকতা ও শুদ্ধাচার শিখে থাকে। 

মাতা-পিতার সেবা করা, বড়োদের সম্মান করা, সত্য কথা বলা, ছোটোদের স্নেহ করা, মানুষ ও অন্য কোনো প্রাণীকে কষ্ট না দেওয়া, অন্যায় না করা, অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেওয়া এসবই নৈতিক শিক্ষার অংশ। তাই নৈতিক শিক্ষা অর্জনের মধ্যে দিয়ে অর্জিত হয় শুদ্ধাচার। 

পারিবারিক জীবনে শুদ্ধাচারের গুরুত্বঃ 


পারিবারিক জীবনে শুদ্ধাচারের ভূমিকা অপরিসীম। যে পরিবারে শুদ্ধাচার আছে, তারা শান্তিময় জীবনযাপন করে। পরিবারে শুদ্ধাচার আছে বলেই তারা একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ফলে পরিবারে কোনো অনভিপ্রেত ঘটনার উদ্ভব হয় না। পক্ষান্তরে, শুদ্ধাচরশূন্য পরিবার অশান্তির ঠিকানা। তারা শান্তিপ্রিয় জীবনে আগ্রহী হলেও শান্তি তাদের কাছে থেকে যায় অধরা। পারিবারিক জীবনে যারা শুদ্ধাচার চর্চা করে, সমাজের অন্যান্য পরিবার তাদের ভাল্যে মানুষ হিসেবে গণ্য করে। তাই পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে আমাদের হতে হবে শুদ্ধাচারপ্রিয়।

ছাত্রজীবনে শুদ্ধাচারের গুরুত্বঃ 


ছাত্রজীবন মানবজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। ছাত্রজীবনে এর প্রতিফলন ঘটে। ফলে ব্যক্তিগত জীবন হয়ে ওঠে নান্দনিক। একজন শুদ্ধাচারী ছাত্র সব শিক্ষক এবং সহপাঠী দ্বারা সমাদৃত হয় এবং বিদ্যালয়ে হয়ে ওঠে প্রিয়পাত্র। অন্যদিকে দুরাচারী ছাত্র নিজে যেমন মন্দ, অন্যের জন্যও সে ক্ষতিকারক। সবাই তাকে অভিসম্পাত করে এবং তার জীবন হয় অর্থহীন।

শুদ্ধাচারী হওয়ার উপায়ঃ 


শুদ্ধাচারী হওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় সাধনা ও ত্যাগের অভ্যাস। শুদ্ধাচারী হতে হলে সর্বপ্রথম অহমিকা, দম্ভ, অহংকার মুছে ফেলতে হবে। আর নিজ নিজ ধর্মের সুদপদেশ মানা, অনুশাসন মেনে চলে শুদ্ধাচার অনুশীলন করা সম্ভব। তবে শৈশব থেকে মানুষের পারিপার্শ্বিকতা নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। তাই শুদ্ধাচারী সন্তানগড়ে তুলতে বাবা-মা ও স্বজনদের দায়িত্ব হচ্ছে শিশুকে উপযোগী পরিবেশ দেওয়া। তবেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুদ্ধাচারী ও বিনয়ী হিসেবে গড়ে উঠবে।

শুদ্ধাচারের প্রয়োজনীয়তাঃ 


ব্যক্তি ও পারিবাকি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য ভালো আচরণ, ভালো রীতিনীতি, ভালো অভ্যাস রপ্ত ও পরিপালন করা অত্যাবশ্যক। কেননা, শুদ্ধাচারের বিপরীতে রয়েছে গর্ব, অহমিকা, দুরাচার, কলঙ্ক ও অন্ধকার। এর সবকটিই মানুষের মন্দ বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিচিত। গর্ব-অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে সুন্দর-সুশৃঙ্খল জীবন গড়তে শুদ্ধাচারের বিকল্প নেই। 

শুদ্ধাচার একটি সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড। নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্য বোঝানো হয়। ব্যক্তি পর্যায়ে শুদ্ধাচারের অর্থ হলো কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা তথা চরিত্রনিষ্ঠা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেবা খাতে শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়নের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্নমুখী আলোচনা হচ্ছে। বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, অসাধুতা ও অনৈতিকতার চর্চারোধে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি দমনে শুদ্ধাচার প্রতিপালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ জন্য সেবাখাতে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা ছাড়া সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের আশা করা বৃথা।

উপসংহারঃ 


মানবজীবনের প্রত্যেকটি বিভাগে শুদ্ধাচারের বিকল্প নেই। শুদ্ধাচারকে একটি একটি গুণ না বলে একগুচ্ছ ভালো আচরণের সম্মিলন বলা যায়। একজন ব্যক্তি ভদ্র নাকি অভদ্র, উদ্ধত নাকি শান্ত- সবকিছুরই প্রকাশ ঘটে ব্যক্তির আচরণে। আচরণের মধ্য দিয়ে মানুষের যথার্থ ব্যক্তিত্বকে নিরূপণ করা যায়। তাই ব্যক্তির আচরণের মধ্যেই শুদ্ধাচারের স্বরূপ বিদ্যমান।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন