হিন্দু আইনের দায়ভাগ ও মিতাক্ষরা মতবাদের পার্থক্য - দায়ভাগ ও মিতাক্ষরা মতবাদের বৈশিষ্ট্য

আজ আমরা আলোচনা করব হিন্দু আইনের দায়ভাগ ও মিতাক্ষরা মতবাদের পার্থক্য এবং দায়ভাগ ও মিতাক্ষরা মতবাদের বৈশিষ্ট্য এ সম্বন্ধে।
হিন্দু আইনের দায়ভাগ ও মিতাক্ষরা মতবাদের পার্থক্য

ভূমিকা (Introduction) 


হিন্দু আইনের উৎকর্ষ সাধনে Schools বা মতবাদগুলির ভূমিকা ও গুরুত্ব সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। স্মৃতিশাস্ত্রের ভিন্নরূপ মতাদর্শের কারণে হিন্দু আইনে বিভিন্ন মতবাদের উদ্ভব হয়। ফলে হিন্দু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মতের প্রতিফলন ঘটে। তাই, The Collector of Maduar Vs. Mootoo (1868) নামক মামলার রায়ে বলা হয় যে, 

"The Commentator put his own gloss on the ancient text; and his authority having been received in one and rejected in another part of India. School with conflicting doctrine arose.” 

ফলে বিজ্ঞানেশ্বর লিখিত ও আলোচিত মিতাক্ষরা মতবাদ এবং জীমুতবাহন লিখিত ও আলোচিত দায়ভাগ মতবাদ প্রকাশিত হয়। ইহাছাড়া, অন্যান্য Sub-Schools বা উপ-মতাবাদ থাকিলেও এই দু'টি মতবাদই বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

দায়ভাগ মতবাদের বৈশিষ্ট্যঃ


  • (১) দায়ভাগ মতবাদ বাংলাদেশে, পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামে প্রচলিত।
  • (২) দায়ভাগ কোন বিশেষ স্মৃতির চলতি ভাষ্য নয়। এটি ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর কোন এক সময়ে জীবমুতবাহন কর্তৃক রচিত সকল স্মৃতির একটি সংহিতা।
  • (৩) দায়ভাগ মতপন্থীদের কাছে এটি প্রামাণিক গ্রন্থ। তবে বাংলাদেশে, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে যেসব প্রশ্নে দায়ভাগে কোন মীমাংসা খুঁজিয়া পাওয়া যায় না কিংবা যেসব বিষয়ে মিতাক্ষরার সহিত দায়ভাগ, দয়াতত্ত্ব ও দয়াকর্ম সংগ্রহের কোন বিরোধ নাই সে সকল বিষয়ে মিতাক্ষরাকে প্রামাণিক গ্রন্থ হিসাবে গ্রহণ করা হয়। অনুরূপভাবে যেসব বিষয়ে মিতাক্ষরায় কোন আলোচনা নাই অর্থাৎ যেসব বিষয়ে মিতাক্ষরা নিশ্চুপ, সেসব বিষয়ে মিতাক্ষরা পন্থীরা দায়ভাগকে উল্লেখ করে থাকে।
  • (৪) দায়ভাগ মতবাদ আধুনিক ও সংস্কারবাদী মতবাদ ।
  • (৫) দায়ভাগ মতবাদ বেঙ্গল মতবাদ নামে পরিচিত।

মিতক্ষরা মতবাদের বৈশিষ্ট্যঃ


  • (১) মিতাক্ষরা বিজ্ঞানেশ্বর কর্তৃক একাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে রচিত যাজ্ঞবন্ধের স্মৃতির উপর একটি চলতি ভাষ্য।
  • (২) মিতাক্ষরা পন্থীরা মিতাক্ষরাকে প্রামাণিক গ্রন্থ হিসাবে অনুসরণ করে।
  • (৩) মিতাক্ষরা মতবাদ গোড়া ও রক্ষণশীল।
  • (৪) মিতাক্ষরা মতবাদ ৪টি উপ-মতবাদে বিভক্ত।
  • (৫) মিতাক্ষরা মতবাদের উপর মতপন্থীরা মিতাক্ষরাকে প্রামাণিক গ্রন্থ হিসাবে অনুসরণ করে কিন্তু তারা মিতাক্ষরার সাথে তাদের নিজ নিজ উপ-মতবাদের ব্যাখ্যাকারগণের গ্রন্থকে অনুসরণ করে।

দায়ভাগ ও মিতাক্ষরা মতবাদের পার্থক্য (Distinction between Dayabhga and Mitakshara School) 


হিন্দু আইনের বিধান মোতাবেক বায়ভাগ ও মিতক্ষরা মতবাদের মধ্যে নিম্নলিখিত পার্থক্যগুলি পরিলক্ষিত হয়-

ব্যাখ্যাগত পার্থক্যঃ


দায়ভাগ হলো, মনু, যাজ্ঞবল্ক ও নারোদ কর্তৃক সংকলিত টিনটি স্মৃতিশাস্ত্রের সামঞ্জস্যপূর্ণ সারাংশ। একে প্রগতিশীল বিধানরূপে গণ্য করা হয়। কিন্তু অপরপক্ষে, মিতাক্ষরা হলো, যাজ্ঞবল্ক প্রণীত প্রাচীন স্মৃতিশাস্ত্র বা স্মৃতি সংহিতার বরাবাহিক ব্যাখ্যা। একে প্রগতিশীল বিধানরূপে গণ্য করা হয় না।

উত্তরাধিকারী হবার যোগ্যতার প্রশ্নেঃ


দায়ভাগ মতে মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধে যারা পিণ্ড দানের অধিকারী হন, তারাই মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হবার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু অপরপক্ষে, মিতাক্ষরা মতে মৃত ব্যক্তির রক্তের নিকট সম্পর্কীয় সিগণ উত্তরাধিকার হবার যোগ্য। অর্থাৎ রক্তের নিকট সম্পর্কের ভিত্তিতে চিরাধিকার নির্ণীত হয়।

উত্তরাধিকারীদের শ্রেণীগত পার্থক্যঃ


দায়ভাগ মতে তিন শ্রেণীর উত্তরাধিকারী রয়েছে যথাঃ সপিন্ড সকুল্য ও সমানোদক। কিন্তু অন্ততঃপক্ষে, মিতাক্ষরা মতে তিন শ্রেণীর উত্তরাধিকারী রয়েছে, যারা হলেন সপিন্ড, সমানোদক ও বন্ধু।

স্বগোত্রীয় ও ভিন্ন গোত্রীয় ব্যক্তির প্রশ্নেঃ


দায়ভাগ মতে সপিন্ডদের মধ্যে সগোত্রীয় (Agnates) এবং দৌহিত্রসহ কতিপয় ভিন্ন গোত্রীয় ব্যক্তি (Cognates) আছে। কিন্তু অপরপক্ষে, দৌহিত্র ব্যতীত সকল সপিন্ডগনস্ট স্বগোত্রীয় ব্যক্তি (Agnate)।

অসতীত্বের প্রশ্নেঃ


অসতীত্বের কারণে বিধবা সহ অন্যান্য মহিলাগণও উত্তরাধিকার লাভ হতে বঞ্চিত হবে। পক্ষান্তরে, ইহার কারণে কেবলমাত্র বিধবাই উত্তরাধিকার লাভে বঞ্চিত হয় অন্য কোন মহিলা নয়।

যৌথ পরিবারভুক্ত সম্পত্তিতে অংশীদার হবার প্রশ্নেঃ


দায়ভাগ মতে জন্মের সাথে সাথে পূর্ব পুরুষাগত সম্পত্তিতে অংশীদার হবার কোন নিয়ম নাই। কেবলমাত্র শেষ উত্তরাধিকারীর মৃত্যুর পর ঐ সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারীত্বের অধিকার জন্মে। পক্ষান্তরে, মিতাক্ষরা মতবাদ অনুযায়ী যৌথ পরিবারের কোন সহ উত্তরাধিকারীর (Co- parcaner) পুত্র সন্তান জন্মিলে ঐ পুত্র জন্মের সাথে সাথে যৌথ পরিবারের সম্পত্তিতে সহ-উত্তরাধিকারী হয়।

সম্পত্তি হস্তান্তরের প্রশ্নেঃ


দায় ভাগ মতে এজমালী পরিবারের যে কোন সদস্য তার এজলাসী সম্পত্তির অংশ অবিভক্ত থাকা অবস্থায় হস্তান্তর করিতে পারেন। পক্ষান্তরে, মিতাক্ষরা মতে যৌথ পরিবারের সহ উত্তরাধিকারীদের এইরূপ ক্ষমতা নাই। কেবলমাত্র যৌথ পরিবারের কর্তাই (Logal Necessity) বা বৈধ প্রয়োজনে সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রয় করিতে পারেন।

Factum Valet নীতি প্রয়োগ ক্ষেত্রেঃ


দায়ভাগ মতে, Factum valet নীতির প্রয়োগ ক্ষেত্রে ব্যাপক। তাই, এই মতে এই মতবাদকে বিশেষভাবে স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু অপরপক্ষে, মিতাক্ষরা মতে এই নীতির প্রয়োগ ক্ষেত্র সীমিত।

প্রযোজ্যের প্রশ্নেঃ


এই নীতি বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য। পক্ষান্তরে, এই নীতি ভারতের পশ্চিম বঙ্গ ছাড়া সমগ্র ভারতবর্ষ ও পাকিস্তানে প্রযোজ্য।

স্বাব্যস্থ হওয়ার প্রশ্নেঃ


দায়ভাগ আইনে যে ব্যক্তি মাতৃপক্ষীয়া উত্তরাধিকারী স্বাব্যস্থ হয়, সে মিতক্ষরা আইনেও মাতৃপক্ষীয় উত্তরাধিকারী বলে স্বাব্যস্থ হয়। কিন্তু, মিতক্ষরা মতে মাতৃপক্ষীয় উত্তরাধিকারীরা সবাই দায়ভাগ মতে মাতৃপক্ষীয় উত্তরাধিকারী স্বাব্যস্থ হয় না।

উত্তরাধিকার লাভের প্রশ্নেঃ


যৌথ পরিবারভুক্ত একজন সহ-উত্তরাধিকারীর একটি পুত্র জন্ম গ্রহণের সাথে সাথে তারা সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার লাভের কোন বিধান নাই। সে শেষ উত্তরাধিকারীর মৃত্যুর পর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার লাভ করবে। কিন্তু মিতক্ষরা মতে সহ উত্তরাধিকারীর পুত্র জন্মের সাথে সাথে যৌথ পরিবারে পূর্ব পুরুষাগত সম্পত্তিতে সহ-উত্তরাধিকারী স্বাব্যস্থ হয় এবং পরিবারের কোন এক সদস্যের মৃত্যুতে জীবিত সহ-উত্তরাধিকারীদের সম্পত্তির বৃদ্ধি পায়।

বিক্রয়ের প্রশ্নেঃ


দায়ভাগ নীতি অনুযায়ী যৌথ পরিবারের যে কোন সদস্য তাহার জমালী সম্পত্তির অংশ অবিভক্ত থাকাকালীন বিক্রয় করতে পারে। কিন্তু, সহ- উত্তরাধিকারীদের যে কোন সদস্যের সে ক্ষমতা নাই। তবে যৌথ পরিবারের কর্তা আইনসঙ্গত এবং বৈধ কারণে অবিভক্ত সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রয় করতে পারে।

আগে উত্তরাধিকার লাভঃ


দায়ভাগে মাতৃপক্ষীয়রা পিতৃপক্ষীয়দের সঙ্গে আসে এবং তারা সাকুল্য ও সমানোদকদের আগে উত্তরাধিকার লাভ করে। অপরপক্ষে, মিতক্ষরা আইনে গোত্রজ সপিণ্ড অথবা সমানোদক থাকিলে কোন বন্ধু বা মাতৃবংশ সম্ভূত জ্ঞাতি উত্তরাধিকার লাভ করে না।

উত্তরাধিকারীর সংখ্যাঃ


দায়ভাগ আইনে মাতৃপক্ষীয় উত্তরাধিকারীর সংখ্যা মিতক্ষরা আইনের তুলনায় সীমাবদ্ধ। কিন্তু মিতক্ষরা আইনে মাতৃপক্ষীয় উত্তরাধিকারীর সংখ্যা ব্যাপক।

সম্পত্তি হস্তান্তরে বাধাঃ


দায়ভাগ আইনে পিতার জীবিতাবস্থায় পুত্র সম্পত্তি বন্টনের দাবী করতে পারে না। এমন কি ভরণপোষণের দাবীও করতে পারে না। পিতা কর্তৃক সম্পত্তি হস্তান্তরে কোন বাধা আরোপ করিতেও পারে না। পক্ষান্তরে, মিতক্ষরা মতে পুত্র পিতার নিকট সম্পত্তি বণ্টন করে চাতে পারে না বটে কিন্তু পিতা কর্তৃক সম্পত্তি হস্তান্তরে বাধা আরোপের সীমিত ক্ষমতা রাখে।

উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি প্রাপ্তির ক্ষেত্রেঃ


দায়ভাগ মতে কেবলমাত্র উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাবার নিয়ম বা বিধান মানিয়া চলা হয়। কিন্তু অপরপক্ষে, মিতাক্ষরা মতে সম্পত্তি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দুইটি নিয়ম মানিয়া চলা হয়। যথাঃ উত্তরাধিকার সূত্র ও উত্তরজীবি সূত্র।

হিন্দু আইনের মতবাদগুলির সংজ্ঞা উদ্ভবের কারণ ও ব্যাখ্যা এবং দায়ভাগ ও মিতাক্ষরা মতবাদের মধ্য পার্থক্য আলোচনা করে উপসংহারে হয়ে সুষ্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, স্মৃতিশাস্ত্রের মতাদর্শের বিভিন্নতার কারণে দায়ভাগ ও মিতাক্ষরা নামে দুইটি প্রধান মতবাদের উদ্ভব হয় এবং এই দুইটি মতবাদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। আমাদের উল্লেখিত আলোচনার মাধ্যমে উভয় মতবাদের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url